ইতিহাস ও ঐতিহ্যের লীলাভূমি ‘বানিয়াচং’

দিলোয়ার হোসাইন, বানিয়াচং

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ইতিহাস ঐতিহ্যের লালনভূমি কিংবদন্তী গ্রামের নাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং। বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে বানিয়াচং খ্যাতি লাভ করেছে। এক সময় বানিয়াচং ছিল প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী। মোগল আমল থেকেই তিলোত্তমা এ গ্রামটি শহর হিসেবে পরিচিত। কিন্তু গ্রামটির নামকরণ সম্পর্কে বহু মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে, বানিয়াচংয়ে পুটিয়াবিল নামে একটি প্রকাণ্ড বিল ছিল। এই বিলে নানাজাতীয় পাখি বসবাস করত। বানিয়া নামে এক শিকারি এই বিলে একটি চাঙ নির্মাণ করে পাখি শিকার করত। কালক্রমে এই বিলটি প্রাকৃতিক কারণে ভরাট হয়ে গেলে বহু উচ্চ বৃক্ষলতাপূর্ণ ভূমিতে পরিবর্তিত হয়। এ ‘বানিয়া’ ও ‘চাঙ’ শব্দ থেকে বানিয়াচং নামের উৎপত্তি বলে বেশিরভাগ মানুষের ধারণা।
গ্রামটিতে জন্ম নিয়েছেন কয়েকজন দেশবরেণ্য মহান ব্যক্তি। তাদের মধ্যে কেউ আবার বিশ্বজয়ও করেছেন। সৃষ্টিকর্তা যেন নিজে অকৃপণ হস্তে সবকিছু দান করেছেন, তারপরও গ্রামটিতে উন্নয়নের ছোঁয়া তেমনভাবে লাগেনি। ৩২ দশমিক ৪৩ বর্গমাইল আয়তনের গ্রামটিতে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার লোক বসবাস করে। এর বেশিরভাগ লোক কৃষি কাজের সাথে জড়িত। ঐতিহাসিক কমলারানীর সাগরদিঘি, লক্ষ্মীবাউরের জলাবন, রাজবাড়ী, বাইসাইকেলে প্রথম বিশ্ব ভ্রমণকারী ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি, মোগল আমলের প্রাচীন মসজিদসহ রয়েছে অনেক পুরাকীর্তি, যা দিয়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।

১৯৯৭ সালের ১৯ অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় এলআর হাইস্কুল মাঠের জনসভায় সাগরদিঘিকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র করার ঘোষণা দেন। দিনাজপুরের রামসাগরের আদলে সাগরদিঘির পাড়েও পর্যটন পার্ক গড়ে তোলা হবে তিনি বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় ২১ বছর পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে আলোর মুখ দেখেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে পাল্টে যেত গ্রামটির অর্থনৈতিক চিত্র। সরকারেরও রাজস্ব আয় হতো কোটি টাকা।

দেশবরেণ্য ও বিশ্বজয়ী ব্যক্তিরা এই গ্রামে জন্ম নিলেও গ্রামটিতে শিক্ষার ছোঁয়া তেমনভাবে লাগেনি। শিক্ষার হার মাত্র শতকরা ৫৮ ভাগ।
পঞ্চাশ খ্রিস্টাব্দে বানিয়াচং গ্রামের গোড়াপত্তন হয় বলে ধারণা। সাধারণত কয়েকটি পাড়া বা মহলা নিয়ে গঠিত হয় গ্রাম। কিন্তু এই সংজ্ঞাকে অচল করে দিয়ে ১২৮টি পাড়া নিয়ে গঠিত এই বৃহত্তম গ্রামটি, যার আয়তন ৩২ দশমিক ৪৩ বর্গমাইল। ৪টি ইউনিয়ন পরিষদে বিভক্ত করা গ্রামটির জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৩৫ হাজার। গ্রামে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের বসবাস। অনাধিকাল ধরে এই দুই সম্প্রদায়ের মাঝে চলে এসেছে সামাজিক সম্প্রীতি। ৮০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি প্রবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণে। বিদেশি রেমিট্যান্স আর্থসামাজিক উন্নয়নে অন্যতম অবদান রাখছে।

জানা গেছে, এক সময় পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো। তখন বানিয়াচং ছিল এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গ্রাম। শিকাগো নগরে রূপ নেওয়ায় আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে বানিয়াচং।
২০০৪ সালের ৭ জুন বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বানিয়াচং উপজেলা সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন বানিয়াচং পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম। এ ছাড়া ড. শেখ ফজলে এলাহী বাচ্চুর ‘বানিয়াচং-এর ইতিবৃত্ত’ বইটিতে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং বলে উল্লেখ করেন। সুলতানি আমলে করদ রাজ্য ও মোগল আমলে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে স্থানান্তরিত লাউর রাজ্যের রাজধানী ছিল বানিয়াচং।

দ্বাদশ শতাব্দীতে গ্রামটিতে কমলারানীর দিঘি খনন করেন রাজা পদ্মনাভ। ৬৬.৯২ একর আয়তনের কমলারানীর দিঘি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দিঘি হিসেবে স্বীকৃত। সাগরের মতো বিশাল হওয়ায় অনেকে সাগরদিঘিও বলে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পল্লি কবি জসীম উদ্দীন বানিয়াচং পরিদর্শনে এলে সাগরদিঘির প্রাকৃতিক পরিবেশও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন এবং এর পাড়ে বসে ‘ও রানী কমলাবতীর দীঘি’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন। এ ছাড়া গ্রামটিতে মজলিশ খাঁর দিঘি, ঠাকুররানীর দিঘি, দেওয়ান দিঘি ও জামাল খাঁর দিঘি নামে চারটি দিঘি রয়েছে। পুরানবাগ মসজিদ, বিবির দরগা, কালিকাপাড়া, দুই নম্বর (রাজবাড়ি) মসজিদ, রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, জয়কালী মন্দির, শ্যামবাউলের আখড়া প্রাচীন স্থাপত্যের নির্দশন হিসেবে এখনো দণ্ডায়নমান। তবে এসব প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষার কোনো লক্ষণ নেই সরকারি বা বেসরকারিভাবে।

বৃহত্তম এই গ্রামটিতে যারা জন্ম নিয়ে দেশ ও বিশ্ববরেণ্য হয়েছেন তারা হলেন-বাইসাইকেলে প্রথম বিশ্ব ভ্রমণকারী ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস, নাইট উপাধিতে ভূষিত ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ, মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা দুই সহোদর স্বর্গীয় হেমসেন, সুশীল সেন, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সহযোদ্ধা মরহুম মৌলভী আব্দুল্লাহ, সাবেক মন্ত্রী ও সাংবাদিক সিরাজুল হোসেন খান, কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দীসহ আরও অনেকে ।

প্রলয় ডেস্ক

Recent Posts

জিয়াউর রহমান এক দূরদর্শী নেতা ও দেশ গঠনের রূপকার: মোহাম্মদ মাসুদ

জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, যিনি ১৯৩৬ সালের ১৯…

12 hours ago

ভালুকায় ইয়াবাসহ ৪ মাদক কারবারি গ্রেফতার

এস.এম ফিরোজ আহমেদ, ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়া এলাকায় শুক্রবার (১৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় ভালুকা…

16 hours ago

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি বছরই ৩টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন: প্রধান উপদেষ্টা

সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, চলতি বছরই রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি…

17 hours ago

এদেশে সবার অধিকার সমান, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ থাকবে না: সেনাপ্রধান

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শনিবার রাজধানীর পলাশী মোড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বললেন,…

17 hours ago

ইসলামী জোটে নির্বাচনে অংশ নেবে খেলাফত আন্দোলন

আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো নীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হলে তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ…

17 hours ago

জামায়াত ও এনসিপির মতো কিছু গোষ্ঠী চায় না দেশে নির্বাচন হোক: দুলু

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন, ‘আগামী…

17 hours ago

This website uses cookies.