কাঁচা মালের দাম বৃদ্ধি ও পুঁজির অভাবসহ নানান সংকটে জর্জরিত শাঁখা শিল্পের কারিগররা

মামুন হোসেন, পাবনা সংবাদদাতা

পরিবহন খরচ, কাঁচা মালের দাম বৃদ্ধি, বাজারে চাহিদা কম ও পূঁজির অভাব সহ নানান সংকটে পড়েছে শাঁখা শিল্পের কারিগররা। তাই পরিবারে সচ্ছলতা ফিরাতে অনেকটাই বাধ্য হয়েই ছাড়ছেন বাপ-দাদার শেখানো এই পেশা। শাঁখারী শিল্পীদের অভিমত, ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সহজ শর্তে ঋণ ও উন্নত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হলে শুধু দেশ নয় দেশের বাহিরেও রপ্তানি সম্ভব বলে মনে করেন তারা। স্থানীয় ও বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা যায়, শঙ্খ শিল্প হলো প্রাচীন ভারতের অন্যতম একটি লোক শিল্প।

হিন্দু ধর্মীয় নীতি মেনে মাঙ্গলিক চিন্হ স্বরূপ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই অনেকে এই অলংকার ব্যবহার করে আসছে। আনুমানিক প্রায় ২০০০ বছর আগে ভারতে উৎপত্তি হয় এই শঙ্খ-শিল্পের। পরে রাজা বল্লাল সেনের হাত ধরে দক্ষিণ ভারত থেকে এই রীতি বাংলাতেও প্রবেশ করে। সেসময় থেকেই বাংলায় ব্যাপকভাবে সূচনা হয় শাঁখা শিল্পের প্রচলন ও ব্যবহার। জানা যায়, শাঁখা সামুদ্রিক শঙ্খ থেকে তৈরি বলয়াকৃতির একপ্রকার অলঙ্কার। সাধারণত হিন্দু বিবাহিত নারীদের হাতে এই অলঙ্কার দেখা যায়।

বিবাহিত হিন্দু নারীরা সিঁদূর, নোয়া ও পলার সাথে দুই হাতে সাদা রঙের শাঁখা ব্যবহার করে থাকে। হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী, বিবাহিত নারীদের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে ব্যবহার হয় শাঁখা, পলা ও মাথায় সিঁদুর। আর এই শঙ্খ কেটেই তৈরি করা হয় শাঁখা ও পলা। বিবাহিত নারীরা অন্যান্য অলংকারের সাথে এই শাঁখা পরে থাকে। তবে ধর্মের রীতি অনুযায়ী, স্বামী যতদিন জীবিত থাকবে ততদিন তারা হাতে শাঁখা পরবে। তবে স্বামীর মৃত্যুর পরে শাঁখা ও পলা ভেঙে দেওয়া হয় বলে জানান তারা।

সুত্র বলছে, হিন্দু বিবাহিত নারীদের শাঁখা ব্যবহারের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিভিন্ন প্রচলিত প্রথা জড়িয়ে আছে। তবে অঞ্চলভেদে এসব প্রথার ভিন্নতা দেখা যায়। অনেকের বিশ্বাস, নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনার জন্যই হাতে এই শাঁখা ব্যবহার করে থাকে। আবার অনেক জায়গায় শাঁখা ব্যবহারকে অপরিহার্য হিসেবেও ধরা হয় না। সরেজমিনে চলনবিল অধ্যুষিত পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ডেফলচড়া শাঁখারী পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফুটতেই যান্ত্রীক পদ্ধতিতে কয়েকটি ধাপে নিপুণ হাতে শঙ্খ কেটে তৈরি করছেন ধলা, জাজী, পাটি, কাঁচ চাম্বর, কাচ্ছাম, কড়ি, চোত্বা, মনিপুরী ও ভিআইপি সহ বিভিন্ন প্রকারের নকশার শাঁখা।

মানভেদে এই শাঁখাগুলো বিক্রি করেন ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। এই শাঁখা তৈরিতে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করছেন নারীরাও। কথা হয় ৪০ বছর ধরে বাপ-দাদার শেখানো পেশায় কাজ করা বাবলু ধরের সঙ্গে তিনি জানান, একসময় পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে এই কাজ শিখেছিলেন তিনি। তিনিও এ পেশায় কাজ করছেন প্রায় ৪০ বছর। বাবলু ধর জানান, একসয়ম এ পেশার রমরমা ব্যবসা থাকলেও। বর্তমানে এ পেশায় তেমন লাভ না থাকায় ও বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় কোনরকমে টিকে আছেন তারা। কথা হয় আরেক কারিগর পরিতস ধরের সঙ্গে তিনি জানান, আগে পাড়ার অনেক পরিবার এই শাঁখা তৈরির সঙ্গে জড়িত থাকলেও, এখন শুধু ৩৪ টি পরিবার এ পেশার সঙ্গে জড়িত। তিনি জানান, ভারত থেকে কাঁচামাল নিয়ে এসে পরিবারের সবাই মিলে তৈরি করেন এই শাঁখা। শাঁখা তৈরির পর বিক্রি করতে পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোর সহ বিভিন্ন জেলার গ্রামগঞ্জে ছুটে যান তিনি। বিক্রির পর যা লাভ হয় তা দিয়েই সন্তানের পড়াশোনা সহ সংসারের খরচ বহন করতে হিমশম খান তিনি। কথা হয় নীলা বতী সেন নামের এক নারী কারিগরের সঙ্গে তিনি জানান, ছোটবেলায় বাবার বাড়িতে এই কাজ শিখেছেন তিনি।

এখন শ্বশুর বাড়িতে করছেন শাঁখা তৈরির কাজ। সন্তানদের পাশাপাশি শিখাচ্ছেন অন্যান্য নারীদেরও। তিনি জানান, সংসারের পাশাপাশি এ কাজ করে বাড়তি আয় করেন তিনি। তবে সরকারি পৃষ্ঠাপোষকতা পেলে নারী উদ্যেক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চান এই নারী। চাটমোহর ডিগ্রী কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মনজিৎসেন শুভ জানান, আমাদের শাঁখা তৈরির সরঞ্জাম থেকে শুরু করে কাঁচামালগুলো আমদানি করতে হয় ভারত থেকে। এতে করে খরচও পরে বেশি। তাই এই শিল্পকে টিকাতে সহজ শর্তে ঋণ ও উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে বাণিজ্যিক ভাবে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

মিততুং জয় সেন, দীপ্ত সেন, অন্তুু কুমার ও ষষ্ঠী সেন নামের কয়েকজন জানান, বাপ-দাদার এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাটা এখন প্রায় বিলুপ্তের পথে। তারা জানান, পরিবহন খরচ ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, পূঁজির অভাব ও বাজারে চাহিদা কম থাকায় এ পেশা ছেড়ে এখন তারা দিনমজুরি সহ বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে সরকারি সহযোগিতা পেলে আবার ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখেন তারা। এবিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন’র উপ-মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শামীম হোসেন বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে কাজ করে বিসিক। শুধু আর্থিক সহোযোগিতা নয়, তাদের পণ্যের নকশা ও আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও বিসিক সহযোগিতা করবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

 

প্রলয়/নাদিয়া

প্রলয় ডেস্ক

Recent Posts

বৈদ্যুতিক খুঁটিতে শর্ট সার্কিট, ভালুকায় কারখানায় অগ্নিকাণ্ড

স্টাফ রিপোর্টার ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার কাঁঠালীতে অবস্থিত ইকরাম সোয়েটার্স লিঃ এর অভ্যন্তরে গত (১৫ এপ্রিল…

21 minutes ago

সদরপুরে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মানববন্ধন

মুহাম্মাদ জাকির হুসাইন ফরিদী, সদরপুর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সদরপুর উপজেলা শাখার আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক…

42 minutes ago

গফরগাঁও এ ভূমি অধিগ্রহণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় ভূমি অধিগ্রহণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আ.ন.ম উবাইদুল্লাহর বিরুদ্ধে জমি মালিকদের…

4 hours ago

কুড়িগ্রাম জেলা সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত

কুড়িগ্রাম জেলা সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবারর (১৮ মে) সকাল সাড়ে ১১টায় কুড়িগ্রাম জেলা…

1 day ago

সরকারের সমালোচনা করা রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার: আশফাক নিপুন

বাকস্বাধীনতার পক্ষে সরব হয়েছেন নির্মাতা আশফাক নিপুন। ‘সরকারের সমালোচনা করা রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার’ হিসেবে তিনি…

1 day ago

জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধে আইনি নোটিশ

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়ার পর এবার জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতি নিষিদ্ধ…

1 day ago

This website uses cookies.