নান্দাইলে রেলওয়ের জমি দখলে চতুর্থ শ্রেণির উসমানের সাম্রাজ্য

সাইফুল ইসলাম,নান্দাইল (ময়মনসিংহ) সংবাদদাতা

পদ মর্যাদায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী,অথচ এলাকাজুড়ে দাপট প্রথম শ্রেণির আমলার চেয়েও বেশি।রাজনৈতিক ছত্রছায়া আর দুর্নীতির জাল বুনে রেলওয়ের জমি দখল করে পাকা বাড়ি গড়ে তুলেছেন ময়মনসিংহের নান্দাইলে রেলওয়ে পয়েন্টসম্যান পদে কর্মরত আলী উসমান।

স্থানীয়দের অভিযোগ,সরকারি সম্পত্তি দখল,চাকরি বাণিজ্য,গাছ কাটা,অনুপস্থিতি সত্ত্বেও নিয়মিত বেতন-সব মিলিয়ে এই উসমান গড়ে তুলেছেন এক ভয়ংকর প্রভাবের বলয়। অথচ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নীরব,প্রশাসনও নির্লিপ্ত।উঠছে প্রশ্ন—চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারীর এতো দাপট কি শুধুই ‘ব্যক্তিগত যোগ্যতা’,না কি এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী রাজনৈতিক আশ্রয়?

রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং স্থানীয় এলাকাবাসীদের বরাতে জানা গেছে, আলী উসমানের বিরুদ্ধে গুরুতর অসংখ্য অভিযোগ, যার অন্যতম সরকারি জায়গা দখল করে স্থায়ী বসতি নির্মাণ, গাছ কাটা এবং চাকরি বাণিজ্য। এসব করে তিনি অর্জন করে নিয়েছেন কোটি টাকার সম্পদ। সেইসঙ্গে ‘টাকার গরমে’ তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী রেলওয়ে শ্রমিক ও কর্মচারী দলের কিশোরগঞ্জ শাখার আহ্বায়ক পদ।

রেলওয়ের ভূসম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী, রেলওয়ে কলোনি ও ইয়ার্ডসংলগ্ন জমি ব্যক্তিগতভাবে লিজ নেওয়া বা ঘর নির্মাণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ এসব নীতিমালা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আলী উসমান দখল করেছেন রেলওয়ের প্রায় ১৫ শতক জমি। এই জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০ লাখ টাকা। দখলকৃত জমিতে নির্মাণ করেছেন পাকা ভবন, যেখানে তিনি বসবাস করছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে।


রাজনৈতিক দাপট আর দুর্নীতির রাজনীতি

২০০৫ সালে মাস্টাররোলে চাকরি নিলেও ২০১৭ সালে চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। এক সময় আওয়ামী লীগপন্থী রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতির পদ দখল করেন মোটা অংকের টাকা খরচ করে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর সেই পরিচয় মুছে ফেলে ফের ঘনিষ্ঠতা বাড়ান বিএনপির ঘরানার শ্রমিক দলের সঙ্গে। এভাবেই ২০২৫ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি জাতীয়তাবাদী রেলওয়ে শ্রমিক ও কর্মচারী দলের কিশোরগঞ্জ শাখার আহ্বায়ক পদ বাগিয়ে নেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেলওয়ে নেতা বলেন, উসমানকে দেখলে বুঝাই যায় না সে চতুর্থ শ্রেণীর একজন কর্মচারী। বিভিন্ন জায়গায় দখল বাণিজ্য গড়ে তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। অথচ একসময় তাদের পারিবারিক অবস্থা ছিলো খুবই করুন। এখন সে টাকার গরমে রেলওয়ের প্রভাবশালী নেতা।

অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য ও সম্পদ অর্জন

স্থানীয় সূত্র বলছে, দায়িত্বে অনুপস্থিত থাকলেও মাস শেষে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে নিয়মিত বেতন তোলেন আলী উসমান। তার বিরুদ্ধে রয়েছে রেলওয়ে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একাধিক অভিযোগ।

কামরুল হাসান নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, “উসমান আলী আমার কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে। আজ না কাল করে শুধু সময়ক্ষেপণ করছে। আমি আমার টাকা ফেরত চাই।”

তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, কিশোরগঞ্জ শহর ও বিভিন্ন এলাকায় কোটি টাকার সম্পত্তি গড়ে তোলার। সবই নাকি ‘তদবির বাণিজ্য’ থেকে অর্জিত। মজার বিষয় হলো, তার বাবা আব্দুর রহমান এবং তিন ভাইও রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।

এলাকা জুড়ে আতঙ্ক, ব্যবস্থা নেয় না পুলিশও

নান্দাইল রোড রেলওয়ে স্টেশনের কর্মচারী সাইফুল ইসলাম বলেন, “উসমানকে নিজ কর্মস্থলে দেখা যায় না। স্টেশনের ডিউটিতে সে থাকেই না। কিন্তু মাস শেষে ঠিকই হাজিরা খাতায় সই করে বেতন তুলে নেয়। কেউ কিছু বলতে গেলে হুমকি দেয়—চাকরি থাকবে না, দেখে নেবো। আমরা আতঙ্কে কিছু বলতে সাহস পাই না।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আরেক কর্মচারী বলেন,“রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশের এলাকায় কে কী করছে, তা উসমানের অনুমতি ছাড়া হয় না। সে এমনভাবে চলে, যেন সে স্টেশনের বড়কর্তা। অথচ সে একজন পয়েন্টসম্যান মাত্র। কিন্তু তার ক্ষমতা আর দাপট দেখে আমরা নিজেরাই চমকে যাই। কেউ কিছু বলতে গেলে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আমাদের বিপদে ফেলবে বলে হুমকি দেয়।”

এদিকে স্থানীয় অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. লিটন মিয়া এবং এসআই বায়েজিদ মৃধা নান্দাইল রোড রেলওয়ে স্টেশনে এসে আলী উসমানের দখলকৃত সরকারি জায়গা ঘুরে দেখেন। গাছ কাটা ও জমি দখলের ব্যাপারে সরেজমিন তদন্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

অভিযুক্তের দাবি: ‘সব ষড়যন্ত্র’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলী উসমান নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সব মিথ্যা। একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করে এসব ছড়াচ্ছে।” চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার কাছে কেউ টাকা পেয়ে থাকলে উপযুক্ত প্রমাণ দিলে আমি টাকা ফেরত দেবো।”

তার বাবা আব্দুর রহমান বলেন,“আমি রেলওয়ে চাকরি করেছি, এখন অবসরে আছি। আমার ছেলে জায়গা লিজ নিয়ে ঘর করেছে। তবে সরকার চাইলে জায়গা নিয়ে নিতে পারে। অনেকেই তো ঘর বানিয়েছে।”

প্রলয় ডেস্ক

Recent Posts

ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ‍‘ভুল বোঝাবুঝির’ অবসান চান টিউলিপ

যুক্তরাজ্যের সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে পদত্যাগ করা টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.…

16 hours ago

গাজায় ঈদের দ্বিতীয় দিনেও নিহত ৫৬

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসনিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকায় আজ ঈদের দ্বিতীয় দিন। গাজা সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, এদিন…

1 day ago

টানা ৫ দিন বৃষ্টির পূর্বাভাস

কয়েকটি বিভাগে টানা পাঁচদিন বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শনিবার সংস্থাটির দেওয়া…

2 days ago

মুসলমানদের ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন পুতিন

সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের পবিত্র ঈদুল আজহা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ…

2 days ago

১২ ঘণ্টার মধ্যেই পরিষ্কার করা হবে কুরবানির বর্জ্য: আসিফ মাহমুদ

অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ…

2 days ago

ত্যাগের মহিমার ঈদুল আজহা আজ

সারা দেশের মুসলিম সম্প্রদায় আজ যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও ত্যাগের মহিমায় উদযাপন করছে পবিত্র ঈদুল…

2 days ago

This website uses cookies.