ভালো শিক্ষক-গবেষক জরুরি কেন?

ড. কামরুল হাসান মামুন

বাংলাদেশে ভালো শিক্ষক-গবেষক নেই। এর পেছনের কারণ কি আমরা খুঁজেছি? ইউনেস্কোর তথ্যমতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৪ হাজার ১১২ জন শিক্ষার্থী বিদেশে যায়। ২০২০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা চারগুণ হয়েছে। আর ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে বিদেশে থেকে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কেন বাড়ছে?

আওয়ামী লীগ সরকার যদি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ইত্যাদি মেগা প্রজেক্ট না নিয়ে ওই টাকা শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ দিত, বিশ্ব মানের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বানানোয় মনোযোগ দিত এবং একই সাথে দেশে দুই তিনটা ওয়ার্ল্ড ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্সটিটিউট বানাতো তাহলে ১৪/১৫ বছরে দেশের চেহারা বদলে যেত।

দেশে আজ একটি জেনারেশন তৈরি হতো যারা উন্নত জ্ঞান, বুদ্ধি ও চিন্তার মানুষ। দেশের মানুষ তখন তাদের স্বপ্রণোদিত হয়ে ভোট দিত। এইসব না করে তারা কী করল? কীভাবে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যায় তার জন্য গোটা প্রশাসনকে ব্যবহার করার জন্য দুর্নীতি করার ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে দিলো।

দেশ দুর্নীতিতে সয়লাব হয়ে গেল। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যখনই ক্ষমতায় গেছে তখনই কীভাবে কৌশলে আজীবন ক্ষমতায় থাকা যায় তার চেষ্টা করেছে। মানুষের মন জয় করে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে চায়নি।

উন্নত দেশ হওয়ার সূত্র হলো, আগে উন্নত মানের শিক্ষা দিয়ে সোনার মানুষ বানাতে হবে তারপর সেই সোনার মানুষ দিয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, বড় বড় সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদি নিজস্ব জনবল দিয়ে বানাতে হবে। তাহলে সেগুলো কম টাকায় বেশি মানসম্পন্ন হতো এবং বিদেশি নিয়োগ দিয়ে কাজ না করিয়ে দেশের টাকা ডলার হয়ে বিদেশে চলে যাওয়া রোধ করা যেত। শিক্ষায় মনোযোগ দিলে দেশে পঙ্গপাল তৈরি হতো না। অসৎ দুর্নীতিবাজ তৈরি হতো না।

উন্নত দেশ হওয়ার সূত্র হলো, আগে উন্নত মানের শিক্ষা দিয়ে সোনার মানুষ বানাতে হবে তারপর সেই সোনার মানুষ দিয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, বড় বড় সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদি নিজস্ব জনবল দিয়ে বানাতে হবে।

এত বছর যাবৎ শিক্ষকতা পেশাকে অনাকর্ষণীয় করে, নিয়োগ বিধিমালা ও দুষ্ট লোক দিয়ে নিয়োগ কমিটি ভরে মানহীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সমাজে একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে আমাদের শিক্ষকরা ভালো না।

আমাদের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ায়, পার্টটাইমে ক্লাসে পড়ায়, জনপ্রতিনিধি তথা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পেছনে ঘুরে, নিজেরা রাজনীতি আর সমিতি করে নানা গ্রুপিং ও তদবিরে ব্যস্ত। এই কথা পুরোপুরি সত্য। কিন্তু এই সত্য অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তৈরি করে শিক্ষাকে একদম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এখন এ থেকে মুক্তির উপায় কী? এখন শিক্ষকতা পেশাকে উন্নত ও আকর্ষণীয় করতে বললেই একদল বলে ওঠে এদের যোগ্যতা নাই, এরা অমুক, এরা তমুক ইত্যাদি। তাহলে কি আমরা এর মধ্যেই আবর্তিত থাকবো? এক জায়গা থেকে তো শুরু করতে হবে।

এটা করলে এখন যারা খারাপ তারা লাভবান হয়ে যাবে বলে কি উচিত কাজটি করা যাবে না? উচিত কাজটি ঠিক করতে হবে ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে। যাতে সেইসময় থেকে যারা নিয়োগ পাবে তারা যেন যোগ্য হয়।

খারাপের উদাহরণ দিয়ে ভালো কিছু না করার যুক্তি কখনোই ভালো না। আর যেন একটি নিয়োগও খারাপ না হয়। শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করার পাশাপাশি একই সাথে আমাদের নিয়োগ বিধিমালাকেও কয়েকটি স্তরে ভাগ করতে হবে যেন তিন স্তরে ফিল্টারিং হয়ে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

একজন অসৎ খারাপ শিক্ষক যেমন অনেক বছর ধরে সমাজের ক্ষতি করে যেতে পারে, যা জলপ্রপাতের ধারার মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পায়; ঠিক তেমনি একটি ভালো নিয়োগ অনেক বছর ধরে সমাজের ভালো করে যেতে পারে যা জলপ্রপাতের ধারার মাধ্যমে লাভ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পায়।

আরেকটি বড় বিষয় হলো বাজেট। ২০২৩ সালের শিক্ষায় নেপাল তাদের জিডিপির ৩.৬৪৯ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে। আমরা দিয়েছিলাম ১.৭৬ শতাংশ! ২০০০ সালের পর থেকে নেপাল তাদের জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়ে আসছে। তার ফল তারা পাচ্ছে।

শিক্ষার মানে নেপাল বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের বেতনে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। মানবিক মানেও নেপালের মানুষ বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। নেপালে বাংলাদেশের মতো এত দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক লুটকারী, পাচারকারী নেই। নেপাল তাদের জিডিপির ১ শতাংশ উন্নয়ন ও গবেষণায় বরাদ্দ দেয়। বাংলাদেশ দেয় ০.০৩ শতাংশ!

এই বছর ভিয়েতনাম শিক্ষায় জিডিপির ৩.৯২ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে আর আমরা দিয়েছি ১.৬৯ শতাংশ! পার্থক্য বুঝতে পারছেন? ৬ বছর যাবৎ ভিয়েতনাম জিডিপির ৩.৫ শতাংশের বেশি শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়ে আসছে। তার ফল ভিয়েতনাম পাচ্ছে।

শিক্ষার মানে নেপাল বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের বেতনে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। মানবিক মানেও নেপালের মানুষ বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে।

এখন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং-এ ৫০০ এর মধ্যে চলে আসছে। শিক্ষায় তাদের উন্নতি ঈর্ষা করার মতো। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ভিয়েতনাম তার জিডিপির ০.৫ শতাংশের বেশি ব্যয় করে আমরা করি ০.০৩ শতাংশ!

পৃথিবীর সব দেশ মিলে ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার উন্নয়ন ও গবেষণায় ব্যয় করে। তার ৮০ শতাংশ ব্যয় করে ১০টি দেশ। আর সেই ১০টি দেশই পৃথিবীতে উন্নত ও ক্ষমতাবান।

তাই কোনো দেশ শিক্ষা ও উন্নয়ন এবং গবেষণায় জিডিপির কত শতাংশ বরাদ্দ দেয় তার উপরই নির্ভর করে সেই দেশ কতটা উন্নত ও সভ্য। বাংলাদেশ এইসব বুঝেও না আর এইসবের ধারও ধারেনি কখনো। জনগণও বুঝে না। উন্নয়ন ও গবেষণায় ০.০৩ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে আমাদের উন্নয়নের গান শুনিয়ে গেল আর আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তা গিলে খেল।

এভাবে আর যাই হোক ভালো শিক্ষক ও ভালো গবেষক তৈরি হবে না, যারা একটু ভালো কাজ করতে চাই তারা দেশের বাইরে চলে যাবে। এখনই সময় শিক্ষা এবং গবেষণায় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করা।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রলয় ডেস্ক

Recent Posts

ভালুকায় ইয়াবাসহ ৪ মাদক কারবারি গ্রেফতার

এস.এম ফিরোজ আহমেদ, ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়া এলাকায় শুক্রবার (১৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় ভালুকা…

2 hours ago

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি বছরই ৩টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন: প্রধান উপদেষ্টা

সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, চলতি বছরই রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি…

2 hours ago

এদেশে সবার অধিকার সমান, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ থাকবে না: সেনাপ্রধান

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শনিবার রাজধানীর পলাশী মোড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বললেন,…

2 hours ago

ইসলামী জোটে নির্বাচনে অংশ নেবে খেলাফত আন্দোলন

আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো নীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হলে তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ…

2 hours ago

জামায়াত ও এনসিপির মতো কিছু গোষ্ঠী চায় না দেশে নির্বাচন হোক: দুলু

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন, ‘আগামী…

2 hours ago

কারচুপি প্রতিহতের প্রস্তুতি নিতে হবে: ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব

আগামী নির্বাচনে কেউ ভোট ডাকাতি বা কারচুপি করতে আসলে তা প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান…

3 hours ago

This website uses cookies.