ফরিদপুরে সিংহপুরুষ মুফতী আব্দুল কাদের রহঃ

মুফতি মুস্তাফিজুর রহমান

ফরিদপুর জামেয়া আরাবিয়া শামসুল উলুম মাদ্রাসার মোহতামিম মুফতী আব্দুল কাদের রহঃ ছিলেন একজন সিংহপুরুষ। রাজপথের লড়াকু সৈনিক। একজন মর্দে মুজাহিদ আলেম। মুফতী আব্দুল কাদের সাহেবকে সিংহপুরুষ উপাধী আমি দেই নি। এটা দিয়েছিলেন, মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহঃ। যিনি ফরিদপুর শহরের লাখো জনতার মাঝে মুফতী আব্দুল কাদের সাহেবকে সিংহপুরুষ বলে সম্বোধন করেছিলেন। জনতার মুহু মুহু স্লোগানে ভরে গিয়েছিল সেদিন।’’

ফরিদপুরের জনতা ব্যাংকের মোড় থেকে আলীপুর কবরস্হান মসজিদ পর্যন্ত লক্ষ জনতার সমাবেশ যেন উত্তাল তরঙ্গ। চারিদিক থেকে মিছিল আর মিছিল। পুরো ফরিদপুর শহর ছিল মিছিলের নগরী। চুতুর্দিক থেকে একেরপর এক শুধু মিছিল আসছে। বৃহত্তর ফরিদপুরের সকল জেলা- উপজেলা, মাগুরা, যশোর, এমনকি খুলনা থেকে তৌহিদী জনতার আগমন ঘটেছিল।’’

খুলনা শহর থেকে এক বড় কাফেলা, যশোর থেকে ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত একদল সৈনিক, মাগুরা থেকে তৌহিদী জনতার বিশাল জমাত শরীক হয়েছিল। গোটা শহরটা দখলে ছিল ঈমানদার জনতার। শুধু কালিমার জিকির আর আল্লাহু আকবার ধ্বনি। যারা বাস্তবে দেখেছেন, তারা হয়ত বলতে পারবেন, সেটা কী দৃশ্য ছিল।’’

মুফতী আব্দুল কাদের সাহেব ছিলেন, একজন মর্দে মুজাহিদ। শুধু নামে নয়। বাস্তবে তিনি দেখায়ে গিয়েছেন। ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে ওঠতেন। যখনই ইসলামের দুশমুনেরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে, তখনি মুফতী সাহেব হুঙ্কার দিয়ে ওঠেছেন। সত্যিকারের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেমিক ছিলেন তিনি। প্রিয় নববীর অবমাননাকারীদের কঠিন শিক্ষা দিয়েছেন। স্তব্ধ হয়েছে তাদের কার্যক্রম। তৌহিদী জনতার আন্দোলনের মুখে নবীর দুশমুনেরা পালাতে বাধ্য হয়েছে।’’

২০০৩ সনে ফরিদপুরের কবি জসিম উদ্দীন হলে “কথা কৃষ্ঞকলি” নাটকের মধ্যে হযরত ফাতিমা রাঃ এর চরিত্র অবমাননা করে নাটক মঞ্চস্হ হয়। এখবর এসে পৌছালো মুফতী আব্দুল কাদের সাহেবের কানে। তিনি যেন ফুঁসে উঠলেন। তাঁর ঈমানী চেতনা যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিলেন কঠিন আকারে। যে ভাবে ব্র্যাঘ্র গতিতে ছুটেছিলেন ময়দানে। নিজের অনুগত আলেম- উলামাদের নিয়ে যেভাবে প্রতিবাদের তুফান উঠায়েছিলেন। তাতে কম্পন শুরু হয়েছিল, নবী এবং সাহাবা দুশমুনদের অন্তরে। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত মানুষ ছুটে এসেছিল ফরিদপুর শহরে।’’

মু্ফতী আব্দুল কাদের সাহেব লড়াকু সৈনিক। হার না মানা এক মুজাহিদের নাম। অদম্য সাহস। বৃহত্তর ফরিদপুরের সকল আলেমদের এক প্লাট-ফরমে এনেছিলেন। যখনই তিনি ডাক দিয়েছেন, হাজার হাজার জনতা উপস্হিত হয়েছে। আলেমগণ ছুটে এসেছে। একটি নাম মুফতী আব্দুল কাদের। তাঁর নামেই জমা হয়েছে।

দক্ষিণ বঙ্গের এক মহান ব্যক্তিত্ব। পদ্মার পারের ওলামা ত্বলাবা এবং আম জনতার মধ্যমণি। যার ব্যক্তিত্বের সামনে সবাই নীচু হয়েছে। মাথা উঁচু করার সাহস কারো ছিল না। এই ব্যক্তিত্ব অর্জনের পিছনে ছিল তাঁর সীমাহীন কোরবানী। যুগ যুগ ধরে বৃহত্তর ফরিদপুরের মানুষের খেদমতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। সর্বস্তরের মানুষের আস্হার প্রতীক হওয়ার পিছনে কত কাঠ- খড় পোড়াতে হয়েছে বছরের পর বছর তার হিসাব নেই। কত মেহনত, কত গায়ের ঘাম ঝরাতে হয়েছে, তা বর্ননা করে শেষ করা যাবেনা।’’

হক- হক্কানিয়্যাতের উপর অটল- অবিচল থাকতে বহু ঝড়- ঝন্জা উপেক্ষা করেছেন। বহু নির্যাতন ভোগ করেছেন দুশমুনদের। বিশেষ করে হকের উপর টিকে থাকতে নবী- সাহাবীদের শত্রুদের হাতে লাঞ্চিত- অপমানিত হয়েছেন। তবুও কিন্তু তিনি বিন্দু পরিমান সরে যান নি সত্য নীতি থেকে।’’

বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে মুফতী আব্দুল কাদের সাহেবের গ্রহণযোগ্যতা ছিল বর্ণনাতীত। এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে মুফতী সাহেবের কদম পড়ে নি। এমন কোন দ্বীনি মারকাজ নেই, যেখানে তিনি যান নি। কারো দাওয়াতের অপেক্ষায় বসে থাকা নয়। বা কোন কিছুর বিনিময়ে নয়। একদম নিঃস্বার্থ ভাবে দ্বীনি প্রোগ্রামে হাজির হতেন। কারো কাছ থেকে বিনিময় গ্রহণ তো করেন নি, বরং ইকরাম এবং সু- পরামর্শ দান করেছেন।’’

ফরিদপুর অঞ্চলে এমন কোন প্রতিষ্ঠান দেখাতে পারবে? যেখানে তিনি যান নি। স্বেচ্ছায় গিয়ে হাজির হতেন মাদ্রাসায় মাদ্রাসায়। খোঁজ- খবর নিতেন। আকাবির- আছলাফের যোগ্যউত্তরসুরী তিনি। দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম এবং দেওবন্দ থেকে আগত মেহমানদের মাথার তাজ মনে করতেন। সেই ২০০০ সনে ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী রহঃ ফরিদপুর সফর করেছিলেন, তখন দেখেছিলাম, আওলাদে রাসুল সাল্লাল্লা আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা। ফেদায়ে মিল্লাতের আগমনকে কেন্দ্র করে পুরো ফরিদপুর যেন সাজ সাজ রব। হাজারো আলেম এবং সহস্রাধিক তলাবা নিয়ে ফেদায়ে মিল্লাতকে ইস্তেকবালের ব্যবস্হা, আবার ফেদায়ে মিল্লাতের প্রোগ্রামগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য তাঁর আন্তরিকতা দেখেছি অনেক কাছ থেকে। একজন নির্লোভ ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। জীবনটা কেটেছে ভাঙা টিনের ঘরে। তাঁর যে জনপ্রিয়তা, তাঁর যত ভক্ত- অনুরক্ত। ইচ্ছে করলে সুরম্য অট্রালিকায় বসবাস করতে পারতেন। ভক্তদের বহু প্রস্তাব এসেছে তাঁর টিনের চালা ফেলে বিল্ডিং করে দিবেন। কিন্তু এই দুনিয়া বিমুখ মানুষটিকে দুনিয়ার কোন সম্পদের মোহ গ্রাস করতে পারিনি। দুনিয়ার আরাম- আয়েশ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি। সাধাসিধে যিন্দেগী। একদম সোজাসুজি চলাফেরা ছিল।’’

এক পাগড়ী ওয়ালা মুজাহিদ। চব্বিশঘন্টা যার মাথায় পাগড়ী বাঁধা দেখেছি। পাগড়ী ছাড়া মুফতী আব্দুল কাদের সাহেবকে দেখা গেছে, এরকম মনেহয় বলা যাবেনা। যেখানে যেতেন, পাগড়ী তাঁর মাথায় শোভা পেত। দীর্ঘ এক যুগ তাঁর কাছাকাছি ছিলাম। তাঁর সোহবতে সময় পার করেছি। বহুবার সফর হয়েছে তাঁর সাথে দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন জেলাতে। এক গাড়ীতে, এক সঙ্গে, অনেক সময় কেটেছে তাঁর মত ব্যক্তিত্বের সাথে। তিনি আমাদের ছারে তাজ। আমাদের মাথার মুকুট। বারবার স্মরণ হয় তাঁর কথা।’’

কদিন পরপর যিনি ফোন দিতেন। বাবাজী আসুন! ফোন নিজে দিতে না পারলে মুফতী মাহমুদ হাসান ফায়েক সাহেবকে বলতেন, মাওলানাকে ফোন দেন, অমুককে ফোন দেন। ফোন দিলে ছুটে যেতাম তাঁর খেদমতে। অত্যান্ত হৃদয় জুড়ানো কথা বলতেন। কথাগুলো একদম হদয়ের গহীন থেকে বের হত।কোন ফাঁক- ফোঁকর থাকত না।’’

ফরিদপুর অঞ্চলের বড় বড় সকল প্রোগ্রামের সভাপতির আসন অলংকৃত করতেন। সবশেষে সভাপতির ভাষণ। অল্প সময় কথা বলতেন, তবে নীরব নিস্তবদ্ধ হয়ে যেত ময়দান। কোন রংঢং ছিলনা। সাদামাটা কথা। তাতেই মনভরে যেত। আজ প্রতিটি মুহুর্তে যেন স্মরণ হয় তাঁর কথা। সেইরকম হৃদয়বান মানুষের বড্ড অভাব।

তিনি চলেগেছেন, তবে তাঁর স্মৃতিগুলো আমরা ভুলতে পারিনা। বাতিল শক্তির আতঙ্ক ছিলেন যিনি। রাজপথের লড়াকু। তাঁকে মনে করবে চিরদিন এদেশের সর্বস্তরের মানুষ। জীবন ও কর্মঃ জন্মঃ মুফতী আব্দুল কাদের সাহেব ১৯৪২ সনের ১৩ আগষ্ট ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার ( বর্তমান সালথা) রামকান্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী হাবিবুর রহমান। মাতার নাম, আমেনা।’’

শিক্ষাজীবন:

প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের স্কুলে। এরপর তৎকালিন সময়ের সংস্কারক, দ্বীন ইসলামের অকুতোভয় সৈনিক আল্লামা আব্দুল আজিজ রহঃ এর প্রতিষ্ঠিত বাহিরদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন লেখাপড়া করার পরে বিশিষ্ট বুজুর্গ হাফেজ ইব্রাহিম সাহেব রহ, প্রতিষ্ঠিত বাকিগন্জ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দুই বছর অত্যান্ত সুনামের সাথে লেখাপড়া করেন।

এরপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য চট্রগ্রাম চলে যান। প্রথমে চারিয়া মাদ্রাসায় কাফিয়া জামাত পর্যন্ত, এরপর হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। দাওরায়ে হাদীস হাটহাজারীতে। ইসলামী আইন শাস্ত্র, ফিকাহ এর কোর্স কমপ্লিট করেন, প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন, মুফতীয়ে আজম, মুফতী ফয়জুল্লাহ রহঃ এর নিকটে। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ায় অত্যান্ত মনযোগী ছিলেন। সর্বদা কিতাব মুতালায় নিমগ্ন থেকেছেন। ছাত্রজীবনে অন্য কোন ফিকির, চিন্তা- চেতনায় সময় পার করেন নি। এমনকি বাড়ীতে আসা হত না। একবার একটানা তিনবছর পর বাড়ীতে এসেছিলেন। যখন নিজ গ্রামে পৌছলেন, তখন জানতে পারলেন, তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার ইন্তেকাল হয়ে গেছে। ছাত্রজীবন এভাবেই কেটেছিল। লেখাপড়া ছাড়া আর কিছু ছিলনা। দুনিয়ার কোন ফিকির তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি তখন।’’

কর্মজীবন:

আসলে বড়দের জীবনী থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে আমাদের। তাঁরা কত মুজাহাদা- কোরবানী দিয়েছেন, সেগুলো দেখে আমাদের ভাবতে হবে। আমরা তো ফারেগ হওয়ার পর ভাল কোন খেদমত না পেলে সময় নষ্ট করে দেই। অনেকে দাওরার কিতাব না পেলে পড়াতে চান না। বাড়ী বসে থাকেন। বেহুদা কাজে ব্যয় করেন। কিন্তু মুফতী আব্দুল কাদের সাহেব কোন সময়ের অপচয় করেন নি। তিনি যখন ফারেগ হয়ে এসেছিলেন, ফরিদপুরে বড় কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। যা ছিল সব ছোট ছোট। তবে তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল, ফরিদপুরে একটি বড় দ্বীনি ইদারা কায়েম করবেন। যার দ্বারা এদেশ থেকে অন্ধকার দুর করে আলো ছড়াবে সে প্রতিষ্ঠান। সেরকম মন-মানসিকতা নিয়ে তিনি সামনে এগিয়েছিলেন।’’

হাটহাজারী থেকে এসে তিনি সর্বপ্রথম নিজেদের বাড়ীর কাচারীতে গ্রামের ছেলেদের দ্বীন শেখাতে থাকেন। শুরুতে নিজের এলাকা থেকে অন্ধকার দুর করতে চেয়েছেন। অত্যান্ত আগ্রহভরে তিনি দ্বীনের তা’লিম দিতে থাকেন। এরপর ডাক আসে বাকিগন্জ মাদ্রাসা থেকে। সেখানে দুবছর সুনামের সাথে শিক্ষকতা করেন। এরপর শাহ ফরিদ দরগাহের পাশে এলাকার কিছু দ্বীনদার মানুষের সহযোগিতায় মাদ্রাসা গড়ে তোলেন। কিন্তু একটি মহলের সমস্যার কারণে আর সামনে বাড়তে পারেন নি। শহরের প্রাণ কেন্দ্র খান প্রেস যেখানে। এর দোতলায় তিনি মাদ্রাসা খুলে দেন। সহযোগিতায় ছিলেন খান প্রেসের মালিক আলহাজ্জ আবুল কাসেম খান সাহেব। পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ল মাদ্রাসার খবর। মানুষ আসা- যাওয়া শুরু করল।শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখানেও পরিবেশটা অনুকুল হল না।

মুফতী আব্দুল কাদের সাহেব হাল ছাড়েন নি। দমে যান নি। তাঁর ইচ্ছা একটা বড় দ্বীনি প্রতিষ্ঠান কায়েম করবেন ফরিদপুর শহরে। তিনি পরামর্শ এর জন্য চলে যান চট্রগ্রামে প্রাণপ্রিয় মুরুব্বী হযরত থানবী রহঃ এর খলিফা আব্দুল ওয়াহাব রহ: এর কাছে। তিনি পরামর্শ দেন, ফরিদপুর শহরে যেখানে জায়গা পাবেন, মাদ্রাসা গড়ে তোলেন। মহান আল্লাহর খাছ অনুগ্রহ, মুফতী আব্দুল কাদের সাহেবের পাহাড়সম ইখলাছ- আমলের বহিঃ প্রকাশ বলা যায়। ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুর এলকায় একাদশ শতাব্দীতে বাগদাদ থেকে আগত এক মহান বুজুর্গ শাহ আব্দুর রহমান গন্জেরাজ রহঃ এর বংশধরগণ মসজিদ- মাদ্রাসার জন্য জায়গা দান করেন। সেই জায়গাতে ১৯৬৯ সনে টিনের দোচালা ঘর নির্মান করে মাদ্রাসার অগ্রযাত্রা শুরু করেন তিনি। একদম হাটিহাটি পা পা করে পথ চলা।’’

প্রথমে মক্তব, এরপর হেফজখানা, এরপর কওমী মাদ্রাসার নেছাব অনুযায়ী তা’লিম। বহু ত্যাগ- তিতিক্ষা, কোরবানী- মুজাহাদা, এক কথায় মুফতী সাহেবের জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের জন্য। জীবনের কোন স্বপ্ন- সাধ তাঁর ছিল না। স্বপ্ন একটাই প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করানো। অক্লান্ত পরিশ্রম। যে পরিশ্রমের কোন অন্ত নেই। যে কষ্টের কোন সীমা নেই। তিনি ফরিদপুর শহরের বুকে বিশাল এক প্রতিষ্ঠান দাঁড় করেছেন। আস্তে আস্তে সেটা দাওরায়ে হাদীসে উন্নীত হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে সুনাম ছড়িয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে তাঁর জীবন কেটেছে। শরীরের রক্ত পানিকরা প্রতিষ্ঠান। যার মেহনতে তৈরী হয়েছে হাজার হাজার দ্বীনের দায়ী। যে প্রতিষ্ঠান হয়েছে, বৃহত্তর ফরিদপুরের আলেম- উলামাদের মারকাজ। যার ওছিলায় আরো হাজারো ইদারা গড়ে উঠেছে।

একজন নির্লোভ দুনিয়া বিমুখ ব্যক্তি:

দুনিয়ার মোহ তাঁকে গ্রাস করেতে পারিনি কোন দিন। সাদামাটা চলাফেরা।কোন আড়ম্বরিতা ছিল না। মুখলিস দায়ী ছিলেন। দ্বীনি কাজকে প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের আরাম- আয়েশের কথা ভাবেন নি কোনদিন। পুরো শহরে একচেটিয়া ভক্ত- অনুরক্ত। ভালবাসার মানুষের অভাব ছিল না। কিন্তু এগুলো নিজের কাজে ব্যবহার করেন নি। সবই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির কাজে বিলিয়ে দিয়েছেন। কত ভক্ত আসত দৈনন্দিন তাঁর কাছে। হাদিয়া- তোহফায় ভরে যেত। সবই থাকত বালিশের নিচে। ওটা কোনদিন নিজের পকেটে যায় নি। অথচ সেগুলো তো তাঁর ছিল। কিন্তু নিজে কিছুই নেন নি। টাকাগুলো মাদ্রাসায় দান করেছেন। মাদ্রাসা উন্নয়নে বিলিয়ে দিতেন। একজন প্রসিদ্ধ বুজুর্গ তিনি। যার দোয়া, যার নেক দৃষ্টিতে অনেকেই উপকৃত হয়েছে। বহু ডাক্তার ফেরত রোগী সুস্হ হয়েছে তাঁর ঝাড়- ফুঁকে। ঐ সমস্ত ব্যক্তিগণ হাদিয়ায় ভরে দিয়েছেন। কিন্তু সবই ব্যয় করেছেন দ্বীনি কাজে। নিজের ভাঙা টিনের ঘরে জীবন পার করে দিয়েছেন।’’

একজন আল্লাহর খাছবান্দা ছিলেন তিনি:

ঈর্ষনীয় ছিল তাঁর আমল। খোদার প্রেমে মাতুয়ারা সব সময়। কোন ছাত্র তাঁকে দেখেনি জামাত ত্যাগ করতে। কেউ তাঁকে দেখেনি ফজরের পরে ইশরাক না পড়ে জিকির- মুরাকাবা না করে মসজিদ থেকে বের হতে। গভীর রাতে মহান প্রভুর সাথে কানাকানিতে মেতে ওঠতেন। রোনাজারী করতেন। এক খাছ দরবেশের সিফাত ছিল তাঁর মধ্যে।’’

রাজপথে মুফতী আব্দুল কাদের সাহেবকে যেমন দেখেছি:

রাজপথের নির্ভীক লড়াকু। কোন শক্তিকে ভয় পান নি। হাফেজ্জীর খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলেন। এরপর তিনি কিন্তু রাজপথে। তাঁর কাজই ছিল বাতিলের মোকাবেলা করা। যখনই বাতিল শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে,তখনই গর্জে ওঠেছেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞাছিল সীমাহীন। বৃহত্তর ফরিদপুরের আলেমদের এক মঞ্চে নিয়ে আসা ছিল তাঁর বড় অবদান। তাঁর জীবদ্দশায় আলেমদের ছিন্ন- ভিন্ন হতে দেন নি। এক জায়গায় রেখেছেন। বিভিন্ন কর্মসুচিতে এক প্লাট- ফরমে দাঁড় করেছেন।

তিনি হকপন্হী সকল আলেমদের সাপোর্ট করেছেন। কাউকে কটাক্ষ করেন নি। সকলে সার্বিক সহযোগীতা করেছেন। যারাই হকের মিশন নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন, সকলকে পুর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনের সকল ওলামায়ে কেরাম- পীর মাশায়েখদের সাথে তাঁর মধুর সস্পর্ক দেখেছি। কাউকে কটাক্ষ করেন নি। উদারতা ছিল তাঁর মধ্যে। যে উদারতা এখন রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন যেন উদারতার মুর্তপ্রতিক।

ইসলামী যে নেতাই ফরিদপুরে এসেছে, তাঁর কাছে গিয়েছেন। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন। হিংসার রাজনীতি তিনি করেন নি। পীর মাশায়েখদের মধ্যে যারাই ইসলাহী মিশন নিয়ে কাজ করেছেন, সকলকেই সমর্থন জানিয়েছেন। মাদানী সিলসিলা, থানবী সিলসিলা, সকলকেই ভালবেসে আগলে রেখেছেন এবং নিজের সহ কর্মিদের সেখানে হাজির করেছেন। সহকর্মিদের আত্মশুদ্ধির মেহনত করায়েছেন।’

দাওয়াত ও তবলীগের জবরদস্ত সাথী ছিলেন তিনি:

মুফতী সাহেব নিজে তবলীগে মেহনত করেছেন। চিল্লা দিয়েছেন অসংখ্যবার। শায়খুল হাদীস হেলাল উদ্দীন সাহেবকে সাথে নিয়ে চিল্লায় বেরিয়েছেন। সেটাতো সকলের জানা। এক সময় তাঁর প্রতিষ্ঠানের মসজিদে ফরিদপুরের তবলীগের মারকাজ ছিল। তিনি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন তবলীগের মেহনতের সাথে। এমনকি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তবলীগের কাজে শরীক থেকেছেন।’

ইন্তেকালঃ ২০১১ সনের ৭ মে তিনি মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। মহান আল্লাহর কাছে দুআ করি, আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে সমাসিন করুন। আমিন।

প্রলয় ডেস্ক

Recent Posts

জিয়াউর রহমান এক দূরদর্শী নেতা ও দেশ গঠনের রূপকার: মোহাম্মদ মাসুদ

জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, যিনি ১৯৩৬ সালের ১৯…

25 minutes ago

ভালুকায় ইয়াবাসহ ৪ মাদক কারবারি গ্রেফতার

এস.এম ফিরোজ আহমেদ, ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়া এলাকায় শুক্রবার (১৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় ভালুকা…

5 hours ago

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি বছরই ৩টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন: প্রধান উপদেষ্টা

সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, চলতি বছরই রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি…

5 hours ago

এদেশে সবার অধিকার সমান, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ থাকবে না: সেনাপ্রধান

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শনিবার রাজধানীর পলাশী মোড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বললেন,…

5 hours ago

ইসলামী জোটে নির্বাচনে অংশ নেবে খেলাফত আন্দোলন

আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো নীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হলে তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ…

5 hours ago

জামায়াত ও এনসিপির মতো কিছু গোষ্ঠী চায় না দেশে নির্বাচন হোক: দুলু

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন, ‘আগামী…

5 hours ago

This website uses cookies.