‘সত্যিকারের পাকিস্তানি’ হওয়াই ছিল ইউনিসের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য

২২ গজে ব্যাটই ছিল তার সবচেয়ে বড় ভাষা। তবে মাঠের বাইরে তিনি ছিলেন বিনয়ের অবতার। ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ইউনিস খান যা অর্জন করেছেন, তা যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য স্বপ্ন। তবে এ সব কিছু নয়, ইউনিস খান জানালেন তার জীবনের লক্ষ্য ছিল ‘সত্যিকারের পাকিস্তানি’ হওয়াই।

১০ হাজারের বেশি টেস্ট রান, ৩৪টি সেঞ্চুরি, ৬টি ডাবল সেঞ্চুরি, একটি ট্রিপল সেঞ্চুরি, ৯টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি, ১০০টি ক্যাচ, দেশের বাইরে ২৩টি সেঞ্চুরি, ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক — এই সবকিছু ইউনিসকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে।

এই সাফল্যগুলো নিয়ে প্রশংসা পেলে লজ্জায় লাল হয়ে যায় তার মুখ। সম্প্রতি এক্সপ্রেস ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,  ‘অর্জন তো একটা বিষয়। কিন্তু যখন মানুষ ভালোবেসে মনে রাখে, বলে তুমি একজন সত্যিকারের পাকিস্তানি—সেটাই তো আসল সাফল্য!’

মার্দানে বেড়ে ওঠা এবং ছয় ভাইয়ের পরিবারে বড় হওয়ার অভিজ্ঞতাই তার ক্রিকেট ভালোবাসার বীজ বুনে দেয়। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই ক্রিকেট খেলতাম। আমি ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ আমার পরিবার আমার খেলার প্রতি ভালোবাসাকে গুরুত্ব দিত।’

তার আদর্শ ছিলেন বড় ভাই শরীফ খান। তার কথা, ‘আমার জন্য শরীফ ভাইই ছিলেন রোল মডেল। তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন, উইকেটকিপার, ওপেনার, মাঝে মাঝে অফস্পিনার, আর দুর্দান্ত ফিল্ডার। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন, দারুণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।’

স্টিল মিল থেকে ইস্পাতকঠিন স্নায়ু
ক্রিকেটে ইউনিস খানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার মানসিক দৃঢ়তা। ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, দেশের ক্রিকেট বন্ধ থাকা, কিংবা বড় ম্যাচ—সব পরিস্থিতিতেই ছিলেন শান্ত ও ধীর। কোত্থেকে পেলেন এই মানসিকতা, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা বাসায় পাওয়া মানসিক প্রস্তুতির ফল। একটা ভালো পরিবেশ মানুষকে গড়ে তোলে, আর আমি তা পেয়েছিলাম পরিবার থেকে।’

৮০-এর দশকে তার পরিবার মার্দান থেকে করাচিতে চলে আসে। স্টিল মিল এলাকার কাছাকাছি বাসা নেয় ইউনিসের পরিবার। ’৯০-এর দশকে করাচির অস্থির পরিস্থিতিতে বড় হওয়া ইউনিসের মানসিকতা গড়ে দেয় আরও শক্ত ভিত। তার ভাষায়, ‘হ্যাঁ, তখন সহিংসতা ছিল, কিন্তু স্বপ্নটা কখনো হারাইনি।’

সহিংসতার শিকারও বনে যাচ্ছিলেন আরেকটু হলে। ২০০৯ সালে করাচিতে পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা দলের বাসে হামলা হলো তখন তিনিও ছিলেন সেখানে। সে স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের টিম বাসে গুলি চলেছে, আমরা লুকিয়ে থেকেছি। সেসব দিন পার করে ক্রিকেট খেললে আর কিছুই ভয় লাগে না।’

১৯৯২ সালে মালির জিমখানা ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন ইউনিস। সেখানে তখন খেলে যেতেন ওয়াহিদ মির্জা, তারিক আলম, রশিদ লতিফদের মতো ক্রিকেটার। ছোট বেলা থেকে বড় বড় ক্রিকেটারদের সাহচর্যও বড় ভূমিকা রেখেছে তার মানসিকতায়, ‘একদম হঠাৎ করে সেরা পরিবেশে চলে এসেছিলাম। ওটাই আমার মনোভাব গড়ে দিয়েছিল।’

২০০০ সালে করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পাকিস্তানের হয়ে অভিষেক হয় তার। সে অভিষেকের দিনেও চাপ তাকে আঁকড়ে ধরেনি একটুও। তিনি বলেন, ‘অভিষেকে ক্যাপ্টেন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি চাপে কিভাবে থাকি। আমি অবাক হয়ে বললাম, চাপ কিসে? যে জীবন দেখেছি, সেটা জানলে এটাকে চাপ বলবে না।’

তুলনায় আগ্রহ নেই একটুও
সম্প্রতি এক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট তার রানের সংখ্যা আর রেকর্ড বিশ্লেষণ করে জানান, সমসাময়িকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন এগিয়ে। তবু যখন কোহলি বা স্মিথের মতো ক্রিকেটাররা আলোচনায় থাকেন, কষ্ট লাগে কি না?

ইউনিসের সহজ উত্তর, ‘একদমই না। আমি আসলে তুলনায় বিশ্বাস করি না। আল্লাহ জানেন আমি কত কষ্ট করেছি। আমার ভক্তদের ভালোবাসাই আমার পুরস্কার। তবে এটুকু বলব, আমাদের ক্রিকেট বোর্ড যদি একটু আন্তরিক হতো, তাহলে আমরা হয়তো আরও সম্মান পেতাম।’

ক্রিকেটে প্রেরণা হিসেবে ইউনিস জানালেন রশিদ লতিফের কাছ থেকে অনেক শিখেছেন। তবে আদর্শ হিসেবে সবচেয়ে বড় জায়গায় রেখেছেন জাভেদ মিয়াঁদাদ আর ইমরান খানকে।

‘মিয়াঁদাদ ভাই আমাদের সবার আইডল ছিলেন। কীভাবে ইনিংস গড়তেন, টিমকে বাঁচাতেন, তরুণদের দিকনির্দেশনা দিতেন, সবকিছুই শেখার মতো। আর ইমরান খান তো ছিলেন আমাদের জাতীয় আইকন।’

ইমরানকে দেখে বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন মনে বুনেছিলেন। সে স্বপ্নটা যখন সত্যি হলো, তখন তিনি নিজেই ছিলেন দলের অধিনায়ক। তখন মনে কী চলছিল আসলে? ইউনিস বলেন, ‘আমার সব সময় ইচ্ছে ছিল বিশ্বকাপ জেতার মতো দলের অংশ হতে, ঠিক যেমন ১৯৯২-তে ইমরান ভাই ছিলেন। ২০০৯-এ আমি নিজেই ছিলাম অধিনায়ক, আমরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, যদি ইচ্ছা আর পরিশ্রম থাকে, তাহলে স্বপ্নও সত্যি হয়।’

 

 

প্রলয়/তাসনিম তুবা 

Md Seyam

Recent Posts

মারা গেলেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ক্রিকেটার সিম্পসন

জমিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক টেস্ট অধিনায়ক এবং প্রথম পূর্ণকালীন কোচ বব সিম্পসন। ৮৯ বছর বয়সে সিডনিতে…

38 minutes ago

গাজাবাসীদের জোরপূর্বক স্থানান্তরের প্রস্তুতি

ইসরায়েল গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে অধিবাসীদের দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। শনিবার (১৬ আগস্ট) ইসরায়েলি…

48 minutes ago

না ফেরার দেশে কারা সহকারী মহাপরিদর্শক আবু তালেব

অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. আবু তালেব আর নেই। রোববার (১৭ আগস্ট) ভোরে হঠাৎ অসুস্থ…

50 minutes ago

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের জামিন শুনানি অক্টোবরে

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় যুবদলকর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ…

53 minutes ago

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চার আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণা

মনোযোগ ফেরাতে বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের ব্রিফ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রোববার (১৭ আগস্ট)…

57 minutes ago

বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নির্দেশ

বিদেশে বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক মিশন, কনস্যুলেট, কূটনীতিকদের অফিস ও বাসভবন থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি…

59 minutes ago

This website uses cookies.