সংবিধান সংশোধন, পুনর্লিখন নিয়ে যত মত

প্রলয় ডেস্ক

বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের জন্য কমিশন করেছে সরকার৷ কিন্তু সংশোধন নাকি পুনর্লিখন হবে তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক৷ অন্তর্বর্তী সরকারের এ বিষয়ে ম্যান্ডেট রয়েছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে কারো কারো৷

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সংবিধানসহ ছয়টি খাতে সংস্কার প্রস্তাবের জন্য কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার৷ এর মধ্যে অন্যতম সংবিধান সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন৷ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজকে এই কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রস্তাব দেয়ার জন্য তিন মাস সময় পাবে কমিশন৷

তবে সংবিধান সংশোধন হবে নাকি পুনর্লিখন এরইমধ্যে সেই আলোচনা শুরু হয়েছে৷ যারা সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষে তাদের যুক্তি, সংবিধান এত বেশি কাটাছেঁড়া করা হয়েছে যে তা সংশোধন করে লাভ নেই৷ তার চেয়ে নতুন করে সংবিধান লেখাই ভালো৷ আর যারা সংশোধনের পক্ষে তারা বলছেন, নতুন করে লেখা হলে ১৫-২০ বছর পর দেখা যাবে আবার সংবিধান প্রণয়নের দাবি উঠছে৷ এতে জটিলতা তৈরি হতে পারে৷ নতুন করে সংবিধান লেখার সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারা৷

যেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পরামর্শ

বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকা, সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখা, বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের সুযোগসহ নানা বিষয়ে সমালোচনা রয়েছে৷ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য এমন কিছু ধারা সংশোধনের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন বিশ্লেষক ও আইন বিশেষজ্ঞরা৷ সংবিধানের কোন জায়গাগুলোতে পরিবর্তন প্রয়োজন এর উত্তরে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘‘আমাদের সংবিধানের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য নাই৷ রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতাই নেই৷ আবার প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা৷ এর একটা ভারসাম্য দরকার৷ আবার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের চরিত্রই পাল্টে দেয়া হয়েছে৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে৷ এটার বিরুদ্ধে রিট হয়েছে৷ রিটে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে তো আর সংশোধনের দরকার নেই৷ আবার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যার মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিং বন্ধ করা হয়েছে সেটাও বাতিল করা দরকার৷ এরকম আরো অনেক সংস্কারের প্রয়োজন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘মোটা দাগে সংবিধানে সেপারেশন অব পাওয়ারের বিষয়টি পরিস্কারভাবে আনা উচিত৷ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে৷ প্রধানমন্ত্রীকে এত বেশি ক্ষমতা দেয়া যাবে না যাতে তিনি স্বৈরাচার হতে পারেন৷ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে সংবিধানে৷ ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন প্রয়োজন, উচ্চ আদালতে বিচারকদের নিয়োগ নীতিরও পরিবর্তন দরকার৷ এরকম আরো কিছু সংস্কার প্রয়োজন সংবিধানে৷’’

ব্যারিস্টার মাহবুব শফিকও বিদ্যমান সংবিধান সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন৷ তবে তার মতে সেটি হতে হবে জনগণের ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে৷ তিনি বলেন, ‘‘সেটা দেশের নাগরিকদের চাহিদার ভিত্তিতে করতে হবে৷ এখন দুই কক্ষের সংসদ, ব্যালেন্স অব পাওয়ার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এসব বিষয়ে কথা হচ্ছে৷ সেগুলো বিবেচনার বিষয়৷ তবে আমরা মানুষ হিসেবে ঠিক না হলে কোনো কিছুই তেমন কাজে আসবে না৷’’

সংশোধন না পুনর্লিখন?

বাংলাদেশের সংবিধানে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ আছে৷ এ পর্যন্ত তা ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে৷ নতুন করে তা কি পুনর্লিখন না পরিবর্তন করা উচিত সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘সংবিধান সংশোধন করেও এটাকে গণমুখী করা যায়৷ কিন্তু এটা এত বেশি কাটাছেঁড়া করা হয়েছে যে, আমি মনে করি নতুনভাবে সংবিধান লেখাই ভালো৷ আর সেটাতো আমাদের বর্তমান সংবিধানকে সামনে রেখেই করা হবে৷ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ৪৭টি সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে৷ এরকম আরো অনেক সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান আসলে মূল চরিত্র হারিয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘সংবিধান হতে হবে আমাদের একাত্তর এবং ২০২৪-এর চেতনা মিলিয়ে৷ তাই আমি মনে করি নতুনভাবে সংবিধান লেখাই ভালো৷ তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান নতুন করে সংবিধান লেখার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন৷ কারণ হিসেবে বলেন, ‘‘আমাদের সংবিধান মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা হয়েছে৷ সেই সংবিধান নতুন করে লেখার চিন্তা দুঃখজনক৷ সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করা যায়৷ সংবিধানেই সেই ব্যবস্থা আছে৷ তবে এই বিতর্কের বাইরে গিয়ে জাহেদ উর রহমান মনে করেন, সংবিধান নতুন করে লেখা হবে না সংশোধন করা হবে তা মূল বিষয় নয়৷ ‘‘মূল কাজ হলো আমাদের সংবিধানে কী পরিবর্তন এবং সংস্কার চাই তা আগে চিহ্নিত করা৷ সেই পরিবর্তন করতে সংবিধান সংশোধন করা হবে নাকি নতুন করে লিখতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে,” বলেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক৷

কতটা গ্রহণযোগ্য হবে?

সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের বর্তমান সরকারের উদ্যোগের সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন৷ তাদের একজন ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক৷ তিনি বলেন, ‘‘সংবিধান সংশোধন বা নতুন করে লেখা তো পরের প্রশ্ন৷ আমার কাছে মনে হয়, এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার আছে তার বৈধতা কী? কারণ আমাদের সংবিধানে কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা নেই৷ তবে জনগণ যদি চায় সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন সবই হতে পারে৷ কিন্তু সেজন্য তো সংসদ লাগবে৷ আগের সংসদ ফিরিয়ে আনতে হবে৷ জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া যদি সংবিধানে কোনো রকম হাত দেয়া হয় তাহলে সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ মতে তা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ৷ তার এমন মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কীভাবে সংবিধান প্রণয়ন ও গ্রহণ করা হয়েছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘১৯৭০ সালে যে নির্বাচন হয়েছিলো সেই নির্বাচনে এমএলএ ছিল৷ প্রাদেশিক সরকার ছিল৷ সেই প্রাদেশিক সরকার ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল একটা সরকার গঠন করে৷ ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে তারা শপথ নেয়৷ তারাই ম্যান্ডেট নিয়ে একটি গণপরিষদ করে সেখানে সংবিধান প্রণয়ন করে৷ এরপর ১৯৭৩ সালে সেই সংবিধানের অধীনে নির্বাচন হয়।

সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ কতটা গ্রহণযোগ্য পাবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমানেরও৷ তিনি বলেন, ‘‘এটা তো নির্বাচিত সরকার নয়। এই সরকারে যারা আছেন তারা তো ছাত্রদের নিয়োগ করা৷ এখানে কৃষক, শ্রমিকসহ, রাজনৈতিক দল এবং নানা মতের লোকসহ সমাজের সব স্তরের প্রতিনিধি তো নাই৷ ফলে এরা যেই কাজ করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার যদি তাদের কাজের বৈধতা না দেয় তাহলে তো কোনো কিছুই কার্যকর হবে না৷ আমরা ডকট্রিন অব নেসেসিটির কথা বলছি৷ সেটা ঠিক আছে৷ কিন্তু এই সরকার যা করবে তা তো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে৷ সেটা না হলে তো সমস্যা। তবে বে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন আইনজীবী ওমর ফারুক৷ তিনি মনে করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংশোধন বা নতুন করে প্রণয়নের ম্যান্ডেট আছে৷’’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘এই সরকার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে৷ সংবিধান সংশোধনের পর যে নির্বাচন হবে সেই সংসদ সেটাকে বৈধতা দেবে৷ আর যা করা হবে সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই করা হবে৷ ডকট্রিন অব নেসেসিটির প্রশ্নও তো আছে৷ গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান গ্রহণ করা যাবে৷’’

প্রলয় ডেস্ক

Recent Posts

২০ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদের মতামত জানাবে বিএনপি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর চূড়ান্ত খসড়া পর্যালোচনা করে আগামী ২০ আগস্টের…

31 minutes ago

মারা গেলেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ক্রিকেটার সিম্পসন

জমিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক টেস্ট অধিনায়ক এবং প্রথম পূর্ণকালীন কোচ বব সিম্পসন। ৮৯ বছর বয়সে সিডনিতে…

2 hours ago

গাজাবাসীদের জোরপূর্বক স্থানান্তরের প্রস্তুতি

ইসরায়েল গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে অধিবাসীদের দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। শনিবার (১৬ আগস্ট) ইসরায়েলি…

2 hours ago

না ফেরার দেশে কারা সহকারী মহাপরিদর্শক আবু তালেব

অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. আবু তালেব আর নেই। রোববার (১৭ আগস্ট) ভোরে হঠাৎ অসুস্থ…

2 hours ago

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের জামিন শুনানি অক্টোবরে

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় যুবদলকর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ…

2 hours ago

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চার আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণা

মনোযোগ ফেরাতে বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের ব্রিফ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রোববার (১৭ আগস্ট)…

2 hours ago

This website uses cookies.