ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য জমা এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা

- আপডেট সময় : ০২:৩৭:১৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪
- / ১৫১ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট শেষে দেশের সরকারি-বেসরকারি ৪৬ ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, যার পরিমাণ এক লাখ ৯০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা।
ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানা প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন দুঃশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটে। এরপর আর্থিক খাতে উচ্চ পর্যায়ে পরিবর্তন এসেছে।
ইতোমধ্যে ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে নতুন করে পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে অনেক দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ভালো ব্যাংকে জমা রাখছেন গ্রাহক। এতে কিছু ব্যাংক নগদ টাকার সংকটে পড়ে আমানতকারীর চাহিদা মতো টাকা দিতে পারছে না। অন্যদিকে দেশের বেশিরভাগ ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য পড়ে আছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক অর্থ সংকটে পড়েছে। তারা গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। তবে এর বাইরে বেশিরভাগ ব্যাংকেই অতিরিক্ত অর্থ পড়ে আছে। ভালো ব্যাংকগুলোতে প্রতিদিনই আমানত বাড়ছে। বাজারে তারল্যের সংকট নেই। এখন দুর্বল কিছু ব্যাংকের অর্থ সহায়তা দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টিতে অর্থ দেওয়া হচ্ছে, খুব শিগগিরই সমস্যা কেটে যাবে।
জানতে চাইলে ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, দেশের বেশিরভাগ ব্যাংকেই তারল্য সমস্যা নেই। বেসরকারি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ব্যাংকেই অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। ভালো ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক সমস্যায় আছে, তারা তারল্য সহায়তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করেছে।
অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে এমন ১০টি ব্যাংক তাদের অর্থ সহযোগিতা করছে। যার গ্যারান্টি দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আশা করছি সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর সমস্যা কিছু দিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, নানা অনিয়মের কারণে কিছু ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে। তাদের অর্থ সহায়তা দরকার। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ দিচ্ছে না, কারণ মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। বাজারে টাকা দিলে এটা আরও বেড়ে যাবে। তাই দুর্বল বা সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংক থেকে ধার দিতে বলা হয়েছে। কারণ সবল ব্যাংকগুলোতে তারল্যের অভাব নেই। তারা অনেক টাকা অতিরিক্ত জমা করে রেখেছে। এখানে ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা দরকার, যেন ধার দিয়ে সমস্যায় না পড়ে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টার হচ্ছে, ধার পরিশোধের নিশ্চয়তা দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় আটটি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এস আলম গ্রুপ। এগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকেরও নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল তারা। এই আটটি ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় আটটি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এস আলম গ্রুপ। এগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।
এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকেরও নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল তারা। এই আটটি ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। তবে এর মধ্যে ছয়টি ব্যাংকের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাদের অনেক শাখায় লেনদেন করার মতো নগদ টাকা নেই। আমানতকারীদের চাপে পড়েছেন শাখা কর্মকর্তারা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়। এর মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা আটটিসহ মোট ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে নতুন করে পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পর্ষদ পুনর্গঠন করা অন্য তিন ব্যাংক হলো- আইএফআইসি, ইউসিবি ও এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের দখলে ছিল আইএফআইসি ব্যাংক, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক।
নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহকদের জমা টাকার সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে আমানতের একটি অংশ অর্থ বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। আর তা সংরক্ষণ করতে হয় সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনার মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে তাদের কাছে থাকা গ্রাহকের মোট আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ ৪ শতাংশ সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) হিসেবে রাখতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শরিয়াহভিত্তিক চারটি ব্যাংক ও প্রচলিত ধারার ৪২টি ব্যাংক তার সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ বা এসএলআর হিসেবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ সংরক্ষণ করে রেখেছে। এর মধ্যে এসএলআর সংরক্ষণে শীর্ষে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। তাদের অতিরিক্ত জমা ৪৯ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত আরও চারটি ব্যাংকে অতিরিক্ত এসএলআর জমা আছে। ব্যাংকগুলো হলো- অগ্রণী, রূপালী, জনতা ও বিডিবিএল।
এ ছাড়া আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ রাখতে হয় বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে। অন্যদিকে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের বিপরীতে নগদে ৪ শতাংশ টাকা ও আমানতের ১৩ শতাংশ পরিমাণ বিল ও বন্ড বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে রাখতে হয়। এ দুটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরিমানার মুখে পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে।
এসএলআর সংরক্ষণে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিদেশি মালিকানাধীন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। তাদের অতিরিক্ত জমা ১৬ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়ার অতিরিক্ত এসএলআর সংরক্ষণ আছে ৮ হাজার ৬১৯ কোটি, পূবালী ব্যাংকের ৮ হাজার ৫৩৪ কোটি ও ব্র্যাক ব্যাংকের ৮ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত এসএলআর সংরক্ষণ আছে আরও ৭টি ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হোসনে আরা শিখা বলেন, ব্যাংকগুলোতে তারল্যের অভাব নেই। অধিকাংশ ব্যাংকে অর্থ পড়ে আছে। কয়েকটি ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টিতে ইতোমধ্যে তাদের অর্থ সহায়তা দেওয়া শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে দুর্বল চার বাণিজ্যিক ব্যাংককে ৯৪৫ কোটি টাকা ধার হিসেবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। দুর্বল অন্য ব্যাংকগুলোও সহায়তা পাবে। আশা করছি এতে করে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলোর সংকট কেটে যাবে।
এদিকে, আর্থিক অনিয়মে দুর্বল হয়ে পড়া বেসরকারি চার বাণিজ্যিক ব্যাংককে ৯৪৫ কোটি টাকা ধার হিসেবে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে সবল পাঁচ ব্যাংক। অর্থ সহায়তা পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তায় এ ধার দিয়েছে অতিরিক্ত তারল্য থাকা সবল পাঁচ ব্যাংক।
সেগুলো হলো- সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ডাচ্-বাংলা ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধার দিতে সবল ১০ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংকগুলো হলো- রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ব্র্যাক, ইস্টার্ন, সিটি, শাহ্জালাল ইসলামী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, পূবালী, ঢাকা, ডাচ্-বাংলা ও ব্যাংক এশিয়া।
সংকটে পড়া সাত ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার তারল্য-সহায়তা চেয়েছিল। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ৫ হাজার কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭ হাজার ৯০০ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক সাড়ে ৩ হাজার কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৫ হাজার কোটি ও এক্সিম ব্যাংক ৪ হাজার কোটি টাকা সহায়তা চায়।
এ ছাড়া এক্সিম ব্যাংকের দখলে ছিলেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
এর মধ্যে সহায়তা পেতে পাঁচটি ব্যাংক ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। এগুলো হচ্ছে- বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।