প্রতিবেশীদের নাক সিটকানো উপেক্ষা করে জাসমা এখন সফল উদ্যোক্তা

সুজন ফকির, গোয়ালন্দ

বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) তৈরিতে বান্ধবীর সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হন গৃহবধূ জাসমা আক্তার (৩৫)। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনিও পুরোদমে ওই কাজ শুরু করেন।
দুই বছরের মধ্যেই জাসমা আক্তারও পেয়েছেন সফলতা। তিনি এখন সফল নারী উদ্যোক্তা। তাঁর বাড়ি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার পশ্চিম উজানচর নবুওছিমদ্দিন পাড়ায়।
যেভাবে শুরু ২০২৩ সালে ফরিদপুর শহরে প্রাণিসম্পদ বিভাগের একটি প্রদর্শনী মেলায় ঘুরতে গিয়েছিলেন জাসমা। তিনি সেখানে বান্ধবী তানিয়ার স্টলে ভার্মি কম্পোস্ট সারের প্রদর্শনী দেখেন। পরে তাঁর বাসায় গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা নেন জাসমা। পরে বান্ধবীর কাছ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে মাটিসহ তিন কেজি কেঁচো কেনেন, বাড়িতে আনেন দুটি গরু। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোবর আর কেঁচো দিয়ে স্বল্প পরিসরে জৈব সার তৈরির কাজ শুরু করেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁকে পরিবার ও প্রতিবেশীদের কটু কথা শুনতে হয়। গোবর আর কেঁচোর গন্ধে বাড়িতে টেকা মুশকিল জানিয়ে তাঁকে বাধা দেন পরিবারের কয়েকজন সদস্য। আর পাড়া-প্রতিবেশীরা নাক সিটকাতে শুরু করেন। তবে মোটেও দমে যাননি জাসমা।

নিজের আগ্রহে জাসমা উপজেলা কৃষি কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে বিনা মূল্যেই পান পাঁচ কেজি কেঁচো। এরপর জাসমা পুরোদমেই কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে মাসে ১৫-২০ কেজি সার তৈরি হতো। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় অনেক কৃষক তাঁর কাছে আসতে শুরু করেন। এবার এ কাজের জন্য বাড়িতে তৈরি করেন একটি টিনশেড ঘর। পরিসর বাড়লে ওঠানো হয় আরেকটি ঘর। এখন প্রতি মাসে ৪০-৫০ মণ সার তৈরি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি সার ১৫-২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। তবে চাহিদার ওপর উৎপাদনের মাত্রা নির্ভর করে।

সরেজমিনে এক দিন ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ঘেঁষে গোয়ালন্দের পশ্চিম উজানচর নবুওছিমদ্দিন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পাশ দিয়ে পূর্ব দিকের পাকা সড়ক ধরে ৫০০ গজ সামনে এগোলে হাতের বাঁয়ে নজর পড়বে ‘জাসমা ভার্মি কম্পোস্ট ও জৈব সার সেন্টার’ লেখা একটি সাইনবোর্ড। দুটি টিনশেড ঘরে বসানো হয়েছে বৈদ্যুতিক যন্ত্র। জাসমা এতে কেঁচো মাটি দিচ্ছেন আর ছোট দানা বের হচ্ছে। মোহাম্মদ আলী নামের এক শ্রমিক এসব ছোট ছোট দানার জৈব সার বস্তায় ভরছেন। আর বস্তাগুলো সাজিয়ে রাখছেন ঘরের এক কোণে। কৃষকেরা এসব বস্তাভর্তি সার নিয়ে যান।

ছোটভাকলা এলাকা থেকে জাসমার তৈরি সার কিনতে এসেছিলেন কৃষক আবদুল মতিন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছয় বিঘা জমিতে টমেটো, বেগুন, পেঁয়াজ আর রসুনের আবাদ করেছেন। রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে তাঁর ফসলি জমিতে মাটির কার্যকারিতা হারায়। কৃষি বিভাগের পরামর্শে একপর্যায়ে সেখানে জৈব সার ব্যবহার শুরু করেন। কয়েক মাস ধরে তুলনামূলক অল্প দামে এসব জৈব সার নিচ্ছেন জাসমার কাছ থেকে। প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ-ছয় মণ সার দরকার হয়। এখন এ সার ব্যবহারে তাঁর ফসলি জমির কার্যকারিতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে মান বেড়েছে উৎপাদিত ফসলেরও।
হচ্ছে কর্মসংস্থান জাসমার সঙ্গে দুজন পুরুষ ও দুজন নারী শ্রমিক নিয়মিতভাবে কাজ করেন। গ্রাম ঘুরে আরও কয়েকজন গোবর সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন খামার থেকে বস্তাপ্রতি ২০-২৫ টাকা দরে গোবর কিনে নেওয়া হয়। শ্রমিক মোহাম্মদ আলী জানান, করোনার পর দীর্ঘদিন এলাকায় বেকার বসে ছিলেন। সংসারে টুকটাক কাজ করতেন। দিনমজুর হিসেবে মাঠে তেমন কাজ পেতেন না। পরে ২০২৩ সাল থেকে জাসমার জৈব সার তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করেন। আমার মতো আরও কয়েকজন সেখানে কাজ করছেন। এ থেকে যে অর্থ আয় হয়, তা দিয়ে ভালোই আছেন।
জাসমা আক্তার জানান, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে এসএসসি পাস করেন। সংসারে স্বামী, শাশুড়ি, দুই কন্যাসন্তান আছে। স্বামী ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। এখন এ কাজে জাসমাকে সহযোগিতা করেন তিনি। আনুষঙ্গিক সব খরচ বাদে প্রতি মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা লাভ হয়। উপজেলা কৃষি বিভাগ সার তৈরির যন্ত্রসহ রিং দিয়েছে। তবে এ পর্যন্ত এ খাতে পাঁচ লাখ টাকার মতো বিনিয়োগ করেছেন। ভবিষ্যতে বায়োগ্যাস তৈরি করার পরিকল্পনা আছে। তাঁর সারের সুনাম দেশে ছড়িয়ে পড়ুক, জৈব সারের ব্যবহার বাড়ুক—এমনটি চান। সেই সঙ্গে নিজেকে জৈব সার তৈরির একজন উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন জাসমা।

সংশ্লিষ্টরা যা বললেন জাসমার স্বামী মাহবুবুল আজম বলেন, ‘দুই বছর আগে দেখি, জাসমা নিজ থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটি দেখে পরিবার এমনকি পাড়াুপ্রতিবেশীদের অনেকে নাক সিটকাতে শুরু করে। পরে আমিই পাশে থেকে ঘর তৈরি করে দিয়েছি। এখানে তৈরি সার এখন গোয়ালন্দের বাইরে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, এমনকি ঢাকাতেও বিক্রি হচ্ছে।’

গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খোকন উজ্জামান বলেন, কৃষি বিভাগের যে পরিমাণ জৈব সারের চাহিদা, জাসমা আক্তারের কাছ থেকে অনেকটা পূরণ করা হয়। জৈব সার ব্যবহারে শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। দিন দিন এর চাহিদাও অনেক বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।

 

প্রলয় ডেস্ক

Recent Posts

জিয়াউর রহমান এক দূরদর্শী নেতা ও দেশ গঠনের রূপকার: মোহাম্মদ মাসুদ

জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, যিনি ১৯৩৬ সালের ১৯…

12 hours ago

ভালুকায় ইয়াবাসহ ৪ মাদক কারবারি গ্রেফতার

এস.এম ফিরোজ আহমেদ, ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়া এলাকায় শুক্রবার (১৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় ভালুকা…

16 hours ago

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি বছরই ৩টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন: প্রধান উপদেষ্টা

সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, চলতি বছরই রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি…

17 hours ago

এদেশে সবার অধিকার সমান, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ থাকবে না: সেনাপ্রধান

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শনিবার রাজধানীর পলাশী মোড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বললেন,…

17 hours ago

ইসলামী জোটে নির্বাচনে অংশ নেবে খেলাফত আন্দোলন

আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো নীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হলে তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ…

17 hours ago

জামায়াত ও এনসিপির মতো কিছু গোষ্ঠী চায় না দেশে নির্বাচন হোক: দুলু

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন, ‘আগামী…

17 hours ago

This website uses cookies.