সংবাদ শিরোনাম ::
নেই সাইনবোর্ড,নেই কাজ,তবু বিল সম্পন্ন নান্দাইলে কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মের ছড়াছড়ি

নান্দাইল (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
- আপডেট সময় : ০৭:৩৬:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫
- / ৫৩ বার পড়া হয়েছে
ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে(কাবিখা-কাবিটা ও টিআর)কর্মসূচির আওতায় কয়েক কোটি টাকার বরাদ্দ পাওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চরম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।সূত্র বলছে,প্রকল্পগুলোতে নিয়ম অনুযায়ী কোনো সাইনবোর্ড টানানো হয়নি,অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ হয়নি।কিছু হলেও সেগুলো হয়েছে নামমাত্র,কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগেভাগেই প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিকাংশ প্রকল্পের বরাদ্দের পুরো অর্থ ছাড় করে দিয়েছে।
এই অবস্থায় স্থানীয়দের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে—এই প্রকল্পগুলো কী আসলে দরিদ্র জনগণের কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের জন্য,নাকি কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক চক্রের লাভের উৎস হয়ে উঠেছে?
সরকার প্রতি বছর কাবিখা-কাবিটা ও টিআর প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।এ বরাদ্দ বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের হাতে।নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প শুরুর নির্দিষ্ট এলাকায় সাইনবোর্ড টানিয়ে প্রকল্পের নাম,ব্যয়,বাস্তবায়নকারী ও সময়কাল উল্লেখ করতে হয়,যাতে জনসাধারণ প্রকল্প সম্পর্কে জানে এবং তদারকি করতে পারে।কিন্তু নান্দাইল উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের কোনো প্রকল্প এলাকাতেই সাইনবোর্ড দেখা যায়নি।ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝার উপায় নেই যে প্রকল্প কোথায় হচ্ছে,কী ধরনের কাজ হচ্ছে,কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে বা কে কাজ করছে।
নান্দাইল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস (পিআইও) প্রকল্প তালিকা বা মোট বরাদ্দ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু জানাতে রাজি হননি। বরং তিনি তথ্য দিতে বারবার গড়িমসি করছেন।(১৮ মে) অফিস সহকারী কাছ থেকে তথ্য জানার জন্য বলে এবং অফিস সহকারী মৌখিকভাবে জানায়,২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে কাবিখা-কাবিটা ও টিআর প্রকল্পে মোট ২৩৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।এর মধ্যে (কাবিটা)দুই কোটি ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৯৯৭ টাকার বিপরীতে ৫৮ টি প্রকল্প,(কাবিখা)গম ১৫৩.৮৫ মেট্রিক টনের বিপরীতে ২১টি প্রকল্প ,(কাবিখা)চাল,১৫৩.৮৫ মেট্রিক টনের বিপরীতে ২১ টি প্রকল্প।অন্যদিকে(টিআর) দুই কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৩৩৮ টাকার বিপরীতে ১৩৫ টি প্রকল্পের বরাদ্দ দেওয়া হয়।এছাড়া (কাবিখা-কাবিটা ও টিআর)তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের তালিকা প্রক্রিয়াদিন বলে জানায়।এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান,ইউপি সদস্য ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প সভাপতিদের হাতে থাকলেও উপজেলা প্রশাসন ও পিআইও নিয়মিত তদারকি পরিদর্শন করার কথা।
কোথাও নেই সাইনবোর্ড,নেই দৃশ্যমান কাজের চিহ্নও
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে,এসব প্রকল্পের বেশিরভাগেই কাজ হয়নি বা হয়েছে খুবই নামমাত্র।উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে,প্রকল্প স্থানে কোথাও সাইনবোর্ড নেই,নেই দৃশ্যমান কাজের চিহ্নও।
নান্দাইল ইউনিয়নের সাভার পশ্চিমপাড়া আব্দুল মন্নান বাড়ি থেকে এরশাদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি ভরাট ও ইউড্রেন নির্মাণ প্রকল্পে ৭.৮০০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ ছিল। প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য খোকন মিয়া দাবি করেন,”চেয়ারম্যান অসুস্থ থাকায় আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল,আমি মাটি ভরাট করেছি।”
তিনি আরও বলেন,”পিআইও অফিস থেকে দু’বার এসে দেখেছে,তারাই তো দেখে বিল দিয়েছে।”কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মন্নান পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন। তার ভাষায়, “আমার বাড়ির রাস্তা প্রকল্পে দিলেও এক কুদাল মাটিও কাটেনি।ওই মেম্বার তো কোনোদিন রাস্তার ধারেও আসেনি।মাটি কেটে কাজ করল কোথায়?”
এ রকমই চিত্র দেখা যায় নান্দাইল ইউনিয়ন পরিষদ মাঠের প্রকল্পেও।মাঠ ভরাট ও এইচবিবি নির্মাণের জন্য ২ লাখ ২৬ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল।প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য লিটন মিয়া সামান্য কিছু পুরোনো রাস্তার মাটি সমান করে এবং সামান্য কার্পেটিং দেখিয়ে পুরো বিল উত্তোলন করেন। অথচ বাস্তবে রাস্তার মাঝখানে এখনো গর্ত রয়ে গেছে,বর্ষার পানি জমে মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে মাটি ভরাট ও গেট সংস্কারের নামে বরাদ্দ ছিল ১০.৬০০ মেট্রিক টন গম।এ প্রকল্পের সভাপতি ছিলেন ইউপি মহিলা সদস্য মদিনা বেগম।স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ-দুই ট্রলি বালি মিশ্রিত মাটি পুরো মাঠে ছিটিয়ে দেওয়া হয়।প্রথম বৃষ্টিতেই সেই মাটি ধুয়ে গিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে আসে মাঠটি। স্থানীয় মনিরুজ্জামান বাবুল বলেন,”একটু বৃষ্টি হলেই মাটি গলে যায়,আগের মতোই কাদা,ঘাস আর গর্তে ভরা মাঠে খেলাধুলা তো দূরের কথা,হাঁটাও মুশকিল।অথচ শুনেছি পুরো টাকা তারা তুলে নিয়েছে।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,এই প্রকল্পগুলোর কার্যকর মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। সরকারি বিধান অনুযায়ী,এসব প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত শেষ হওয়ার কথা।অথচ এখনই (মে মাসে) প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিকাংশ প্রকল্পের পুরো বিল দেওয়া হয়ে গেছে।স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে,এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়।প্রতিবছরই বরাদ্দ পাওয়া মাত্রই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক একটি চক্র সমন্বয় করে আগেভাগেই বিল উত্তোলন করে নেয়।
নান্দাইল উপজেলার কয়েকজন জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,প্রকল্পের বরাদ্দ বিল ছাড়ের আগে ‘কমিশন নির্ধারণ’করা হয়।পিআইও অফিস এমনকি উপজেলা প্রশাসনের কিছু অংশের সঙ্গে ‘পার্সেন্টেজ’ভাগাভাগি হয় বলেও অভিযোগ করেন তারা।কেউ কেউ সরাসরি বলেন,“কাজ করো বা না করো—বিল পেতে হলে কমিশন দাও,এটাই রীতি হয়ে গেছে।”
নান্দাইল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ বলেন,”প্রকল্পের কাজ প্রাক্কলন অনুযায়ী হয়েছে,সেজন্যই বিল দেওয়া হয়েছে।প্রকল্প সভাপতিদের সাইনবোর্ড দিতে বলা হয়েছিল,তারা দেয়নি।” তবে প্রশ্ন উঠেছে—সাইনবোর্ড না থাকলে বা কাজ দৃশ্যমান না হলে কীভাবে বিল ছাড় করা হলো? প্রকল্পের সাইনবোর্ড অনুপস্থিত থাকা মানেই সাধারণ মানুষের জানার অধিকার ক্ষুণ্ণ করা এবং স্বচ্ছতা লঙ্ঘন।
অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা: ইউএনও
এই বিষয়ে জানতে চাইলে নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সারমিনা সাত্তার বলেন,“অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”তবে ইতোমধ্যেই নানা অনিয়ম এবং দায়সারা তদারকির অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের দিকেও।ফলে প্রকল্পগুলো বাস্তবে জনগণের কল্যাণে না গিয়ে কিছু গোষ্ঠীর ‘লুটের উৎস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামগ্রিক চিত্র বলছে,’কাজের বিনিময়ে টাকা’ প্রকল্পের নামেই চলছে কাজ ছাড়া টাকার খেলা।সাইনবোর্ড নেই,কাজ নেই,তদারকি নেই,কেবল বরাদ্দ তোলা আর ভাগাভাগি। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এ সংস্কৃতি সরকারি অর্থের অপব্যবহারকে নিয়মে পরিণত করেছে।
সরকার যেখানে স্বচ্ছতা,জবাবদিহিতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলে,সেখানে মাঠপর্যায়ের এই চিত্র প্রশাসনিক ব্যর্থতার নগ্ন প্রমাণ।জনগণ জানতে চায়,এসব অনিয়মের জন্য আদৌ কেউ শাস্তি পাবে কিনা,নাকি আরও একটি বরাদ্দের বছর শেষে পুরোনো কাহিনী আবার নতুন করে লেখা হবে?
প্রলয়/ তাসনিম তুবা