শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:৫৭ পূর্বাহ্ন
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি
নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য পরিচয় দিয়ে রিয়াদ খান ওরফে দেলোয়ার হোসেন (৪৮) খোলেন ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সি। বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রসেস করে বিদেশে পাঠানোর শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। বিদেশগামীদের প্রলোভন দেখাতেন সরকারিভাবে ঋণ পাইয়ে দেয়ারও। যৌথ বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছেন। নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য পরিচয় দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে আটক রিয়াদ খান ওরফে দেলোয়ার হোসেন এর প্রতারকের খপ্পরে পড়ে দেড় শতাধিক যুবক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে ওই প্রতারক ধরা পড়ায় আরও শত শত যুবক প্রতারণার কবল থেকে রক্ষা পেলেন বলে জানান স্থানীয়রা।
মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) দুপুরের দিকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে সরেজমিনে অনুসন্ধানে এমন তথ্যই উঠে আসে। দেলোয়ার হোসেন মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়ীখাল ইউনিয়নের মনিমণ্ডল গ্রামের মৃত গোলাম নবী হোসেন খানের ছেলে। তার প্রকৃত নাম রিয়াদ খান হলেও প্রতারণার কাজে তিনি দেলোয়ার হোসেন নাম ব্যবহার করেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গোয়ালন্দ পৌরসভার নছরউদ্দিন সরদার পাড়ায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে হানিফ বিশ্বাসের একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে খোলা হয়েছে ‘এরাবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া এন্ড জব প্রসেসিং’ নামে ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সি।
আরো পড়ুন-
মহাসড়কের পাশেই বড় করে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে। সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘বিদেশগামী যাত্রীদের ভিসার ওপর লোন প্রসেসিং করাসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রসেসিং করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানটি অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য দ্বারা পরিচালিত। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, একটি কক্ষে বিদেশগামী পাঁচ যুবকের সঙ্গে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে কথা বলছেন প্রতিষ্ঠানের মালিক রিয়াদ খান ওরফে দেলোয়ার হোসেন। সাংবাদিক কাছেও নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য পরিচয় দেন তিনি। তবে প্রথমে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দেন। প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত দুজন উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন বলে জানান তিনি।
এ সময় প্রতিষ্ঠানের বৈধতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, বৈধ সব কাগজপত্রই তার আছে। তবে এই মুহূর্তে অফিসে নেই, পরে দেখাতে পারবেন। তার সঙ্গে প্রায় ২০ মিনিট কথা বলার পর তিনি সেনাবাহিনীতে কোন পদে চাকরি করতেন সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তা তিনি সঠিকভাবে বলতে পারছিলেন না। একবার বলেন ডিআইডি, আরেকবার বলেন ডিএডি। এক পর্যায়ে সাংবাদিক প্রশ্নের মুখে তিনি নিজেকে প্রতারক বলে স্বীকার করেন। প্রতারণার উদ্দেশ্যে তিন মাস আগে তিনি ওই বাড়ি ভাড়া নিয়ে ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সি খুলে বসেন বলেও স্বীকার করেন। আর মানুষ যাতে তাকে সহজে বিশ্বাস করে এজন্য তিনি নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দেন।
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তাও এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত নয় বলেও জানান তিনি। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে খবর দেয়া হলে রিয়াদ খান ওরফে দেলোয়ার হোসেনকে আটক করে যৌথবাহিনী। এ সময় তার অফিসে আসা ভুক্তভোগী রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের ফজলুর রহমান বলেন, একজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমি আমার ছেলে রাইসুল ইসলাম রাব্বীকে সৌদি আরব পাঠানোর জন্য এই অফিসে আসি। এখানে আসার পর দেলোয়ার হোসেন আমাকে জানান, আমার ছেলের সৌদি আরব যাওয়ার জন্য মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা লাগবে। ৭০ হাজার টাকা তাকে অগ্রিম দিতে হবে আর বাকি ৩ লাখ টাকা তিনি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সরকারিভাবে ঋণ পাইয়ে দেবেন।
এছাড়া ছেলের মেডিকেল করার জন্য আলাদা ১৩ হাজার ২০০ টাকা লাগবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাকে অগ্রিম ৭০ হাজার টাকা দেই। আর মেডিকেল করার জন্য ১৩ হাজার ২০০ টাকা দেই। আমার ছেলেসহ ১৭ জনকে তিনি একসঙ্গে ঢাকা থেকে মেডিকেল করিয়ে এনেছেন। মেডিকেল করার দিন আমিও ছেলের সঙ্গে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি বাড়ির ভেতর ক্লিনিক খুলে বিদেশগামীদের মেডিকেল করা হচ্ছে। সেদিনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। আজ এসেছিলাম খোঁজখবর নিতে। আমার সামনেই দেলোয়ার হোসেন একজন প্রতারক বলে আপনাদের (সাংবাদিকদের) কাছে স্বীকার করলেন।
আজ জানলাম তার আসল নাম রিয়াদ খান। আমি আমার টাকা ফেরত চাই ও প্রতারকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আরেক ভুক্তভোগী সদর উপজেলার চন্দনী ইউনিয়নের বাড়াইজুরি গ্রামের মো. শকিল শেখ বলেন, ‘আমি সৌদি আরব যাওয়ার জন্য এই অফিসে আসি। দেলোয়ার হোসেন নামে ওই ব্যক্তি নিজেকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য পরিচয় দিয়ে আমাকে বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ৩ লাখ টাকা ঋণ পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন। এছাড়া মেডিকেল করার জন্য তিনি আমার কাছ থেকে ১৩ হাজার ২০০ টাকা নেন। এখন দেখছি তিনি প্রতারক। আমার সৌদি আরব যাওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গেল। আমি প্রতারকের শাস্তি চাই।
গোয়ালন্দ উপজেলার কুমড়াকান্দি এলাকার আকাশ নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘ রাশিয়া পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে দেলোয়ার হোসেন পাসপোর্ট করে দেয়ার জন্য আমার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ও মেডিকেল করে দেয়ার জন্য ১৬ হাজার টাকা নিয়েছেন। আগামী বৃহস্পতিবার আমার পাসপোর্ট দেয়ার কথা। এখন দেখছি তিনি প্রতারক। আমি আমার টাকা ফেরত চাই ও প্রতারকের শাস্তি চাই।
গোয়ালন্দঘাট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রিয়াদ খান ওরফে দেলোয়ার হোসেন তার প্রতারণার কথা স্বীকার করেছেন। কাউকে বিদেশে পাঠানোর তার কোনো বৈধতা নেই। তিনি বিদেশে পাঠানোর কথা বলে দেড় শতাধিক বিদেশগামীর কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অন্তত ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ভুক্তভোগীরা বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবেন। এ ব্যাপারে পরবর্তী আইনি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।