ঢাকা ০৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫, ২ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
জিয়াউর রহমান এক দূরদর্শী নেতা ও দেশ গঠনের রূপকার: মোহাম্মদ মাসুদ ভালুকায় ইয়াবাসহ ৪ মাদক কারবারি গ্রেফতার রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলতি বছরই ৩টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন: প্রধান উপদেষ্টা এদেশে সবার অধিকার সমান, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ থাকবে না: সেনাপ্রধান ইসলামী জোটে নির্বাচনে অংশ নেবে খেলাফত আন্দোলন জামায়াত ও এনসিপির মতো কিছু গোষ্ঠী চায় না দেশে নির্বাচন হোক: দুলু কারচুপি প্রতিহতের প্রস্তুতি নিতে হবে: ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ত্রিশালে জমকালো আয়োজনে ক্রিকেট ফাইনাল খেলায় চ্যাম্পিয়ন ‘জুনিয়র টাইগার’ দুর্গাপুরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে আনন্দ র‌্যালি চাঁদাবাজদের বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ইতিহাসে কালের সাক্ষী ঠাকুরগাঁওয়ে জ্বীনের তৈরি বালিয়া মসজিদ

প্রলয় ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৪:১৭:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫
  • / ৭১ বার পড়া হয়েছে

সিরাজুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও

ইতিহাসে কালের সাক্ষী হয়ে দারিয়ে আছে ঠাকুরগাঁয়ের বালিয়া মসজিদ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে উত্তর-পূর্বের ভুল্লী বাজার নামে একটি মসজিদ রয়েছে, ছোট বালিয়ার জায়গায় শাঠবন্দি দেয়াল নামে পরিচিত।

মসজিদটি তৈরি হয়েছিল এক রাতেই। জ্বিন-পরীরা সারারাত জেগে এই মসজিদ বানিয়েছে। অনেক রকমের কারুকার্যময় অলংকরণ ও পুরু দেয়াল গড়তে গড়তে রাত শেষ হয়ে যায়। দিনের আলোয় জ্বিন-পরীরা থাকে না, তাই গম্বুজের কাজ শুরু না করেই তারা চলে যায়। অসম্পূর্ণ থেকে যায় মসজিদটি-ঠাকুরগাঁওয়ের প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে প্রচলিত আছে এমনই লোককাহিনী।

মসজিদের গায়ে খোদাই করা সন অনুসারে মসজিদটি নির্মিত হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে মানে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ। মুঘল স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী ডিজাইনকৃত এই মসজিদটি নির্মানের কাজ শুরু করেন জমিদার মেহের বকস চৌধুরী। দিল্লির আগ্রা মতান্তরে মুর্শিদাবাদ থেকে আনা স্থপতি দিয়ে কাজটি শুরু হলেও হঠাৎ প্রধান স্থপতির মৃত্যুর ফলে মসজিদ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। মেহের বকস স্থানীয় কারিগরের সহায়তায় পুনরায় মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন কিন্তু স্থানীয় কারিগরগণ মসজিদের গম্বুজ নির্মাণে ব্যথ হন। ১৯১০ সালে মেহের বকস চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। মেহের বকসের ছোট ভাই কয়েক বছর পর মসজিদটি নির্মাণের জন্য আবারও উদ্যেগ নেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না করে তিনিও মৃত্যু বরণ করেন। ফলে মসজিদটি ১০০ বছর গম্বুজ ছাড়াই দাড়িয়েঁ থাকে। অবশেষে মেহের বকস চৌধূরী প্রোপৌত্র তসরিফা খাতুনের পৃষ্ঠপোষকাতায় ও প্রত্নতত্ব ইনস্টিটিউটের কারিগরী সহায়তায় ২০১০ সালে বালিয়া মসজিদটির সংস্কার কাজ শুরু হয়। একই সাথে আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল এর নকশায় নতুন ভাবে গম্বজ নির্মাণ করা হয়।

ছায়াঘেরা শান্ত পরিবেশ। সদর দরজা, খোলা চত্বর আর মূল দালান তথা নামাজ ঘর- এই তিন অংশে মসজিদ কমপ্লেক্স। মোঘল স্থাপনার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ।

স্হানীয় সুত্রে জানা যায় মসজিদটি আগে এরকম ছিল না। ঘন জঙ্গলে চারপাশ পরিপূর্ণ ছিল। দেয়ালে শ্যাওলা, ইটের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রকমের জংলি গাছ উঁকি দিত। ছাদ, গম্বুজ অথবা দরজা জানালা ছিল না। তাই বৃষ্টিতে ভেতরটা বেশ স্যাঁতস্যাঁতে থাকতো। ভেতরে ছিল সাপের বসবাস। ‘আমরাই এই মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এটিকে নামাজ আদায়ের উপযুক্ত করে তুলা হয়,সেটা শুরু হয় ২০০৫ সালে। প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১০ সালে মসজিদটি স্বনামধন্য ভাস্কর কামরুজ্জামান স্বাধীন এই চৌধুরী বংশেরই সন্তান। মূলত তিনিই মসজিদটির পুনঃনির্মানের পরিকল্পনা করেন। ভগ্ন দশা থেকে মসজিদটিকে বর্তমান এই রূপ দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

কোনও পিলার নেই মসজিদটিতে। ৪২ ইঞ্চি প্রশস্ত দেয়ালের উপরে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর এই মসজিদ। দেয়ালের চাইতে নিচের দিকের প্রশস্ততা অনেক বেশি। ভিত্তি পর্যন্ত এই প্রশস্ততা বেড়েছে। প্ল্যাটফর্মের দেয়াল একেবারে নিচের দিকে ৭৪ ইঞ্চি চওড়া। মাটির নিচে সেটি আরও বেশি। আয়তাকার এই মসজিদ উত্তর দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আর পূর্ব পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি দীর্ঘ। তবে মূল ভবনটি ১৭ ইঞ্চি প্রশস্ত।

মসজিদ নির্মাণে হাতে তৈরি ইটের সঙ্গে চুন সুরকীর ব্যবহার করা হয়েছে। অলংকৃত নকশাগুলো ঘণ্টা, আমলকি, কলস, বাটি, পদ্ম আকৃতির। যা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা। দেয়ালে কোনও রকমের আস্তরণ নেই। পুরনো অবয়বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উপরে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি সুউচ্চ গম্বুজ। মসজিদের প্রধান ফটকটির দৈর্ঘ্য ২১ ফুট আর প্রস্থ ৯ ফুট। বিশাল আকৃতির সদর দরজাটিই এই মসজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ রকম ফটকওয়ালা মসজিদ এই অঞ্চলে চোখে পড়বে না দ্বিতীয়টি।দুই গম্বুজবিশিষ্ট প্রবেশপথটি একটি স্বতন্ত্র স্থাপনা।

মসজিদের ইতিহাস সমপর্কে জানা যায়, মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের অধিনস্থ শালবাড়ি পরগণার স্থানীয় বালিয়ার জমিদার কন্যা গুলমতি চৌধুরানীই মূলত এই মসজিদের নির্মাতা। তবে সমস্ত কর্মকাণ্ড তদারকি করতেন তার স্বামী মেহের বক্স চৌধুরী। মেহের বক্স চৌধুরীর পূর্বপুরুষ মোঘলদের সাথে এই এলাকায় আসেন বলে জানা যায়। তার আগ্রহেই ১৮৬০ সালের দিকে মসজিদ নির্মাণে এগিয়ে আসেন গুলমতি চৌধুরানী। ১৯০৫ সালে মেহের বক্স চৌধুরী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মসজিদের কাজ চলে। পরবর্তিতে নানা কারণে মসজিদটির কাজ আর এগোয়নি। এ রকম বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রাচীন মসজিদ একেবারে ব্যক্তিগত চেষ্টায় পরিপূর্ণ করে তোলার ঘটনা একেবারেই বিরল। সৌখিন এই মনোমুগ্ধকর মসজিদ টি দেখতে প্রতিনিয়ত দুরদুরান্ত থেকে অনেক মানুষ এই মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আসে।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

ইতিহাসে কালের সাক্ষী ঠাকুরগাঁওয়ে জ্বীনের তৈরি বালিয়া মসজিদ

আপডেট সময় : ০৪:১৭:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫

সিরাজুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও

ইতিহাসে কালের সাক্ষী হয়ে দারিয়ে আছে ঠাকুরগাঁয়ের বালিয়া মসজিদ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে উত্তর-পূর্বের ভুল্লী বাজার নামে একটি মসজিদ রয়েছে, ছোট বালিয়ার জায়গায় শাঠবন্দি দেয়াল নামে পরিচিত।

মসজিদটি তৈরি হয়েছিল এক রাতেই। জ্বিন-পরীরা সারারাত জেগে এই মসজিদ বানিয়েছে। অনেক রকমের কারুকার্যময় অলংকরণ ও পুরু দেয়াল গড়তে গড়তে রাত শেষ হয়ে যায়। দিনের আলোয় জ্বিন-পরীরা থাকে না, তাই গম্বুজের কাজ শুরু না করেই তারা চলে যায়। অসম্পূর্ণ থেকে যায় মসজিদটি-ঠাকুরগাঁওয়ের প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে প্রচলিত আছে এমনই লোককাহিনী।

মসজিদের গায়ে খোদাই করা সন অনুসারে মসজিদটি নির্মিত হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে মানে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ। মুঘল স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী ডিজাইনকৃত এই মসজিদটি নির্মানের কাজ শুরু করেন জমিদার মেহের বকস চৌধুরী। দিল্লির আগ্রা মতান্তরে মুর্শিদাবাদ থেকে আনা স্থপতি দিয়ে কাজটি শুরু হলেও হঠাৎ প্রধান স্থপতির মৃত্যুর ফলে মসজিদ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। মেহের বকস স্থানীয় কারিগরের সহায়তায় পুনরায় মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন কিন্তু স্থানীয় কারিগরগণ মসজিদের গম্বুজ নির্মাণে ব্যথ হন। ১৯১০ সালে মেহের বকস চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। মেহের বকসের ছোট ভাই কয়েক বছর পর মসজিদটি নির্মাণের জন্য আবারও উদ্যেগ নেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না করে তিনিও মৃত্যু বরণ করেন। ফলে মসজিদটি ১০০ বছর গম্বুজ ছাড়াই দাড়িয়েঁ থাকে। অবশেষে মেহের বকস চৌধূরী প্রোপৌত্র তসরিফা খাতুনের পৃষ্ঠপোষকাতায় ও প্রত্নতত্ব ইনস্টিটিউটের কারিগরী সহায়তায় ২০১০ সালে বালিয়া মসজিদটির সংস্কার কাজ শুরু হয়। একই সাথে আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল এর নকশায় নতুন ভাবে গম্বজ নির্মাণ করা হয়।

ছায়াঘেরা শান্ত পরিবেশ। সদর দরজা, খোলা চত্বর আর মূল দালান তথা নামাজ ঘর- এই তিন অংশে মসজিদ কমপ্লেক্স। মোঘল স্থাপনার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ।

স্হানীয় সুত্রে জানা যায় মসজিদটি আগে এরকম ছিল না। ঘন জঙ্গলে চারপাশ পরিপূর্ণ ছিল। দেয়ালে শ্যাওলা, ইটের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রকমের জংলি গাছ উঁকি দিত। ছাদ, গম্বুজ অথবা দরজা জানালা ছিল না। তাই বৃষ্টিতে ভেতরটা বেশ স্যাঁতস্যাঁতে থাকতো। ভেতরে ছিল সাপের বসবাস। ‘আমরাই এই মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এটিকে নামাজ আদায়ের উপযুক্ত করে তুলা হয়,সেটা শুরু হয় ২০০৫ সালে। প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১০ সালে মসজিদটি স্বনামধন্য ভাস্কর কামরুজ্জামান স্বাধীন এই চৌধুরী বংশেরই সন্তান। মূলত তিনিই মসজিদটির পুনঃনির্মানের পরিকল্পনা করেন। ভগ্ন দশা থেকে মসজিদটিকে বর্তমান এই রূপ দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

কোনও পিলার নেই মসজিদটিতে। ৪২ ইঞ্চি প্রশস্ত দেয়ালের উপরে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর এই মসজিদ। দেয়ালের চাইতে নিচের দিকের প্রশস্ততা অনেক বেশি। ভিত্তি পর্যন্ত এই প্রশস্ততা বেড়েছে। প্ল্যাটফর্মের দেয়াল একেবারে নিচের দিকে ৭৪ ইঞ্চি চওড়া। মাটির নিচে সেটি আরও বেশি। আয়তাকার এই মসজিদ উত্তর দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আর পূর্ব পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি দীর্ঘ। তবে মূল ভবনটি ১৭ ইঞ্চি প্রশস্ত।

মসজিদ নির্মাণে হাতে তৈরি ইটের সঙ্গে চুন সুরকীর ব্যবহার করা হয়েছে। অলংকৃত নকশাগুলো ঘণ্টা, আমলকি, কলস, বাটি, পদ্ম আকৃতির। যা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা। দেয়ালে কোনও রকমের আস্তরণ নেই। পুরনো অবয়বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উপরে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি সুউচ্চ গম্বুজ। মসজিদের প্রধান ফটকটির দৈর্ঘ্য ২১ ফুট আর প্রস্থ ৯ ফুট। বিশাল আকৃতির সদর দরজাটিই এই মসজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ রকম ফটকওয়ালা মসজিদ এই অঞ্চলে চোখে পড়বে না দ্বিতীয়টি।দুই গম্বুজবিশিষ্ট প্রবেশপথটি একটি স্বতন্ত্র স্থাপনা।

মসজিদের ইতিহাস সমপর্কে জানা যায়, মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের অধিনস্থ শালবাড়ি পরগণার স্থানীয় বালিয়ার জমিদার কন্যা গুলমতি চৌধুরানীই মূলত এই মসজিদের নির্মাতা। তবে সমস্ত কর্মকাণ্ড তদারকি করতেন তার স্বামী মেহের বক্স চৌধুরী। মেহের বক্স চৌধুরীর পূর্বপুরুষ মোঘলদের সাথে এই এলাকায় আসেন বলে জানা যায়। তার আগ্রহেই ১৮৬০ সালের দিকে মসজিদ নির্মাণে এগিয়ে আসেন গুলমতি চৌধুরানী। ১৯০৫ সালে মেহের বক্স চৌধুরী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মসজিদের কাজ চলে। পরবর্তিতে নানা কারণে মসজিদটির কাজ আর এগোয়নি। এ রকম বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রাচীন মসজিদ একেবারে ব্যক্তিগত চেষ্টায় পরিপূর্ণ করে তোলার ঘটনা একেবারেই বিরল। সৌখিন এই মনোমুগ্ধকর মসজিদ টি দেখতে প্রতিনিয়ত দুরদুরান্ত থেকে অনেক মানুষ এই মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আসে।