বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৪ অপরাহ্ন
শাকুর মাহমুদ চৌধুরী, উখিয়া
কক্সবাজারের উখিয়া – টেকনাফে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে চলমান তহবিল সংকটের কারণে শিক্ষা কার্যক্রমে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) জানিয়েছেন যে, এ সংকটের কারণে ইতিমধ্যে এক হাজারেরও বেশি শিক্ষাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরও আড়াই হাজারেরও বেশি কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে বর্তমানে চার হাজারের বেশি শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শিশু শিক্ষালাভ করছে। এসব কেন্দ্র বন্ধ হলে, এই বিপুল সংখ্যক শিশুর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
গত ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) তাদের অনুদান বন্ধের ঘোষণা দেয়, যার প্রভাব কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর উপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে ২০টিরও বেশি এনজিও তাদের শতাধিক কর্মী ছাঁটাই করেছে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি প্রকল্পসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে।
এনজিও কর্মকর্তাদের দাবি, আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রায় চার লাখ শিশুর জন্য চার হাজার লার্নিং সেন্টার কাজ করছে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান বন্ধ হওয়ার পর শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। আশ্রয়শিবিরে কর্মরত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, আশ্রয়শিবিরগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তহবিলের ওপর নির্ভরশীল শিক্ষাকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, অন্যান্য শিক্ষাকেন্দ্রও বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং বর্তমানে এই কেন্দ্রগুলো চালু রাখার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
শুধু শিক্ষা নয়, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর স্বাস্থ্যসেবা এবং পুষ্টি প্রকল্পও সংকটের মুখে পড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য সহায়তার পরিমাণ সাড়ে ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলারে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত আগামী এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। এর ফলে শিবিরগুলোতে শিশুদের পুষ্টি এবং পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
তহবিল সংকটের কারণে আশ্রয়শিবিরগুলোতে চুরি, ডাকাতি, খুনোখুনি, এবং মাদকব্যবসা বৃদ্ধি পেতে পারে। এ পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যত এবং শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এনজিও সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, বিপুলসংখ্যক কিশোর ও তরুণ মাদক এবং সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়তে পারে, যার ফলে এলাকার নিরাপত্তা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়বে।
এছাড়াও, আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৯৫টি শিশু জন্ম নিচ্ছে, এবং প্রতি বছর জন্ম নিচ্ছে ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু। গত আট বছরে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জন্ম নিয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার শিশু। তহবিল সংকটের কারণে এই শিশুরা যথাযথ পুষ্টি ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে, যা তাদের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
এনজিও কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন যে, তহবিল কমে যাওয়ার ফলে শিশু-কিশোরেরা পাচারের শিকার হতে পারে, শিশুশ্রম বেড়ে যেতে পারে এবং অপরাধমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে পারে। আশ্রয়শিবিরে বিকল্প আয় বা কাজের সুযোগ না থাকার কারণে, এসব শিশুদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
রোহিঙ্গা নেতাদের মতে, সরকার এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত না হলে এই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। এছাড়া, বিকল্প আয়ের সুযোগ তৈরি করা এবং শিবিরে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা জরুরি। খাদ্যসহায়তা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় সীমিত তহবিলের কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠবে, এবং এই সংকট দীর্ঘমেয়াদী মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্স ফোরামের কক্সবাজার শাখার সভাপতি, সিনিয়র আইনজীবী আবদুস শুক্কুর বলেছেন, খাদ্য সহায়তা কমানো হলে, প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য মাসিক বরাদ্দ ২৬ টাকা হবে, যা দিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব। তিনি সতর্ক করেছেন যে, তহবিলের অভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও চরম দারিদ্র্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
এক্ষেত্রে সরকারের জরুরি পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর স্থিতিশীলতা এবং শরণার্থীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।