পূবাইলে কাজী পরিচয়ে অভিনব প্রতারণা, বাড়ছে বাল্যবিবাহের প্রবণতা

- আপডেট সময় : ০৭:৩২:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫
- / ১৩৬ বার পড়া হয়েছে
আনোয়ার হোসেন, নিজস্ব সংবাদদাতা
গাজীপুর মহানগরীর পূবাইলের আশেপাশে এলাকায় দেড় যুগ ধরে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রীর কাজ করেন। প্রতি মাসে তিনি অন্তত ৫০/৬০ টি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করেন। সে হিসাবে গত দেড় যুগে প্রায় সাত হাজারের বেশি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করেছেন। তবে মহানগরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজীদের তালিকায় সিহাব নামে কারো নাম নেই। তাকে কি, কাজী হিসেবে কাজ চালিয়ে আসছেন কথিত এই কাজী সিহাব।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রতি শুক্রবার তিন থেকে চারটি বিয়ে হয়। বেশিরভাগ বিয়ে হয় আসরের নামাজের পর। এছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনও কম-বেশি বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন হয়। সবগুলো বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করেন সিহাব।
ভুয়া কাজী নিয়ে পূবাইল ও আশেপাশের থানাগুলোতে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক ভাসমান কাজী। যাদের আইনগত বিয়ে পড়ানোর এখতিয়ার নেই। কাজী হিসেবে নিয়োগ পেতে যেসব যোগ্যতা বা আইনের বিধি বিধান রয়েছে তার কোনোটাই তাদের নেই। কিছু অসাধু ব্যক্তিরা ভুয়া কাজীর মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ ওই ভুয়া কাজীদের গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যার ফলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বাল্য বিবাহের প্রবণতা।
এছাড়া পূবাইলের আশপাশের থানাগুলোর অলিগলিতে কাজী আছে, অফিসও আছে, নিয়মিত বিয়েও পড়াচ্ছেন। আছে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রার, সরকার নির্ধারিত বালাম বইও। তবে সেটা ভুয়া। তাদের নেই আইনগত কোনো বৈধতাও। সেই সাথে কাজীর নেই সরকারি নিবন্ধনও। তবুও কথিত কাজী পরিচয়েই বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করছেন বছরের পর বছর। জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। নিবন্ধন ছাড়াই ভুয়া বিয়ে রেজিস্ট্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এসব নামসর্বস্ব কাজীর ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। আসল ভেবে ভুয়া কাবিননামা, তালাকনামা দাখিল করে সম্পত্তির অধিকার, পিতৃত্ব ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিতের ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবুও ভুয়া কাজীদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই।
মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে গণমাধ্যমে খবর আসলেও প্রতিকার মিলছে না। ফলে পাড়া-মহল্লাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে কাজী অফিস। বেপরোয়াভাবেই চালাচ্ছেন তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড। সম্প্রতি কুদাব এলাকায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ের অলিখিত খালি নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে অসাধু আইনজীবীদের মাধ্যমে বিয়ের হলফনামা বা স্বামী স্ত্রী মর্মে ঘোষণা তৈরি করেছেন। কাজী সিহাবের নাবালিকা ছেলে মেয়েদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কোর্টে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ের হলফনামা তৈরি করায় দিনদিন বাল্যবিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জানা গেছে, নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রারদের কেন্দ্রীয় কোনো পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। কোন এলাকায় কাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার তথ্য নেই। তাই সারা দেশে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতাও সৃষ্টি হয়েছে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের কার্যক্রমে। এমন অবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, স্থায়ীকরণ, জবাবদিহিতা ও শাস্তি নিশ্চিতকরণের বিষয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এদিকে পুরোনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিয়ে ও বিচ্ছেদ নিবন্ধিত হওয়ার জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
তাদের মতে, ভুয়া কাজীর দৌরাত্ম্য কমাতে নিকাহ-তালাক নিবন্ধনে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার জরুরি। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটও হয়েছে। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বিয়ে ও ডিভোর্সের ক্ষেত্রে পারিবারিক জীবনের বৃহত্তর সুরক্ষায় ডিজিটালাইজড রেজিস্ট্রেশনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
কাজী সিহাবের দ্বারা প্রতারণার শিকার পূবাইল থানার কুদাব এলাকার আবির নামের এক যুবক জানান, কথিত কাজী সিহাব উনার বাসায় এসে সাড়ে চার হাজার টাকার বিনিময়ে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে বিয়ে পড়িয়েছে। কিন্তু আইনগতভাবে কাবিননামা রেজিষ্ট্রী করা বাধ্যতামূলক হওয়া স্বত্বেও আইনবহির্ভূত অলিখিত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে বিয়ের হলফনামা তৈরি করে দিয়েছে।
এবিষয়ে জানতে কথিত কাজী সিহাবের সাথে যোগাযোগ করা হলে উনি জানান, উনি কাজী নজরুল ইসলামের সহকারী। উনি আবিরের বিয়ের বিষয়সহ সকল অভিযোগ অস্বীকার করে কৌশলে এড়িয়ে যায়। কিন্তু এই কথিত কাজী সিহাবের বিয়ে করানোর সময় ধারণকৃত ভিডিও এর বিষয়ে জানতে চাইলে উনি বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত আছেন সাক্ষাত করবেন বলে তথ্য প্রদান না করে কৌশলে এড়িয়ে যায়।
ভুয়া কাজীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গাজীপুর জজকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সরকার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান রিপন বলেন, ‘অবৈধ ও ভুয়া বিয়ে এবং তালাক নিবন্ধনের দায়ে ওই কাজীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দণ্ডবিধিতে আছে। দণ্ডবিধির ৪১৭ ধারা অনুযায়ী কাজীর এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। নিবন্ধিত না হয়েও বৈধ কাজীর রূপ ধারণ করে কাজ করা প্রতারণার সামিল। অপরদিকে মুসলিম বিয়ে ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন-১৯৭৪ অনুযায়ী অনূর্ধ্ব দুই বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। তবে বিভিন্ন সময় ভুয়া কাজী ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে আসে, কিন্তু তাদের শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। ভুয়া কাজীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এমন অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।