বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২২ অপরাহ্ন
মো. মামুন হোসেন, পাবনা
চলনবিল অধ্যুষিত পাবনা চাটমোহর উপজেলার বিভিন্ন খাল বিলে চায়না দুয়ারি জাল পেতে অবাধে পোনা মাছ নিধন করা হচ্ছে। এসকল চায়না দুয়ারি জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ, সাপ, কুইচা, কাঁকড়া, ব্যাঙ, শামুকসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। এতে করে সংকটের মুখে পড়েছে চলনবিলের জীববৈচিত্র। সঠিক আইন প্রণয়ের মাধ্যমে এসকল অবৈধ জাল ব্যবহার বন্ধের দাবি জানান সচেতন মহল।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, কারেন্ট জালের থেকেও ভয়ংকর এই চায়না দুয়ারি জাল। নাম যতটা সুন্দর ততটাই ভয়ংকর এই জাল। মাছের জন্য এই জালকে মরণ ফাঁদ হিসেবেই মনে করছেন স্থানীয়রা। শুধু দেশি প্রজাতির মাছ নয় বরং সকল ধরনের জলজ প্রাণী ধরা পড়ে এই জালে। স্বল্প ব্যয় ও স্বল্প পরিশ্রমে অধিক আয়ের উৎস হওয়ায় জেলেদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই ভয়ংকর জাল। উপজেলার প্রায় সব জলাশয়েই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই জাল।
স্থানীয়রা জানান, লোহার রডের গোলাকার বা চতুর্ভুজ আকৃতির কাঠোমোর চারপাশে জাল দিয়ে ঘিরে এই চায়না দুয়ারি ফাঁদ তৈরি করা হয়। ক্ষেত্রভেদে চায়না দুয়ারি এক থেকে দেড় ফুট উচ্চতা এবং ৫০ থেকে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ক্ষুদ্র ফাঁসবিশিষ্ট ঢলুক আকৃতির হয়ে থাকে। এই ফাঁদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, নদীর তলদেশে লম্বালম্বিভাবে লেগে থাকে। ফলে যে কোন ধরনের খাদ্যদ্রব্য ছাড়াই জালের দুইদিক থেকে মাছ ঢুকে আটকা পড়ে। চলনবিলের বিভিন্ন স্থানে এই চায়না দুয়ারি জাল ব্যবহার করে নির্বিচারে মাছ নিধন করা হচ্ছে। খুব সহজে বেশি মাছ ধরায় এই ফাঁদ ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে জেলেদের। ফলে দিনে দিনে সংকটে পড়ছে চলনবিলের দেশি মাছ ও জীববৈচিত্র।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বিভিন্ন বিলের ছোট-বড় খাল ও জলাশয়ে এসব জাল দিয়ে অবাধে মাছ শিকার করছে স্থানীয়রা। এসকল জাল দিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিলাঞ্চলের জেলে ও সৌখিন মৎস্য শিকারিরা। এছাড়াও বিভিন্ন বাজার ও রাস্তাঘাটে যে সকল দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ ও মাছের পোনা বিক্রি হচ্ছে বেশিরভাগ মাছই চায়না দুয়ারি দিয়ে ধরা বলে জানান স্থানীয়রা। বর্ষার প্রজনন মৌসুমে জালে এসকল দেশী মাছ ধরা পরায় মাছের প্রজনন ব্যপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে ক্রমশই নদ-নদী, খাল বিলে মাছশূন্য হয়ে পড়ছে বলে দাবি সচেতন মহলের।
কথা হয় হান্ডিয়াল জগন্নাথপুর এলাকার নাজমুল হাসান মুরাদের সাথে তিনি জানান, আষাঢ় মাসে চলনবিলে নতুন পানি আসার পরপরই এলাকার জেলেরা মাছ ধরায় নেমে পড়ে। তিনি জানান, নতুন পানিতে ডিম ছাড়ার পর অবৈধ কারেন্ট জাল ও চায়না দুয়ারি জালসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে মাছগুলো ছেঁকে তোলায় পোনা মাছের বংশবিস্তারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে একদিকে যেমন প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে দেশী প্রজাতির মাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। মাঠ পর্যায়ে চায়না দুয়ারি জাল ধ্বংসের পাশাপাশি এই নিষিদ্ধ জাল উৎপাদন ও বাজারজাতকরনে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জোড় দাবি জানান তিনি।
হান্ডিয়াল পাকপাড়া গ্রামের মুকুল হোসেন বলেন, সকাল থেকে বিকাল, আর সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত এই চায়না দুয়ারি জাল নদীতে ফেলে মাছ ধরা হয়। এতে করে জালে ধরা পড়ে দেশীয় প্রজাতির মাছসহ জলজ প্রাণী কাঁকড়া, শামুক, কুচিয়া ও ব্যাঙ। তিনি জানান, বেশিরভাগ জালে মাছের চেয়ে অন্যান্য জলজ প্রাণীই আশঙ্কাজনক হারে বেশি মারা পরে। এসব অবৈধ জাল এখনই বন্ধ করা না গেলে চলনবিলের জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে কয়েকজন মৎস্য শিকারিরা বলেন, চায়না দুয়ারি জালে ছোট দারকিনা, মলা, চিংড়ি, চান্দা, খলিশা, পুঁটি, টেংরা, বাতাসি মাছ থেকে শুরু করে শোল, বোয়াল, গজার, টাকিসহ কোন মাছই রেহায় পায় না। বেশিরভাগ জালে মাছের চেয়ে সাপ, কুইচা, কাঁকড়া, ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুকসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী বেশি ধরা পড়ে। এগুলো থেকে তারা শুধু মাছ ও কুইচা বিক্রি করেন। বাকি সব জলজ প্রাণী মেরে ফেলেন।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল মতিন বলেন, চলনবিলে মাঝে মধ্যেই অভিযান চালানো হচ্ছে। মাছ নিধন ও অন্যান্য জলজ প্রাণী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা হবে। এই জালের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নিয়ে যেতে আমরা মৎস্য অধিদফতর কাজ করছেন বলে জানান তিনি।