গাছি সংকটে শূণ্য রসের হাড়ি

- আপডেট সময় : ০৮:২০:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৮২ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক
ছয় ছেলের মধ্যে একজনও গাছে উঠতে পারে না অথচ এই রস দিয়েই ভাত খেয়ে স্কুলে যেত ছেলেরা এমনটাই বলছিলেন গাছি আব্দুর রাজ্জাক। শীতকালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খেজুরের রস। কুয়াশার চাদরে মোড়া শীতের সকালে খেজুরের রস পানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি অমৃত স্বাধের স্মৃতি। তারই সাথে সাথে জড়িয়ে আছে রস দিয়ে বানানো বাহাড়ি শীতের পিঠা-পায়েস। দেশের অন্যান্য জেলার মতোই ইতিমধ্যেই ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায়ও জেকে বসেছে শীত। শীতের সকালে গাছিদের খেজুরের রস সংগ্রহের কর্মচাঞ্চল্য দেখা যেত। সকাল হলে বাড়ি বাড়ি রস জ্বাল করে গুড় তৈরি করা হত। তবে এ বছর কিছুটা ভিন্ন চিত্র চোখে পড়েছে। রস সংগ্রহের ভরা মৌসুমে মুক্তাগাছা উপজেলায় শত শত খেজুর গাছ থাকলেও রস সংগ্রহে গাছিদের কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই বলছেন মুক্তাগাছায় কোন প্রশিক্ষিত গাছি নেই তাই এমন দশা।
তবে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন সংস্থা গাছিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেও মুক্তাগাছায় তেমনটি দেখা যায়নি। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শত শত খেজুর গাছ পরিত্যাক্ত পড়ে আছে। গাছির অভাবে গাছগুলো পরিত্যাক্ত থাকায় অনেক খেজুর গাছের মালিক গাছগুলো ইট ভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছেন। এছাড়াও অনেক গাছের মালিকেরা বলছেন, অনেক গাছি এখন তাদের আগের পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাই সময়মতো গাছি পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য খেজুর গাছ খালি পড়ে থাকছে। শুধু গাছ ফেলে রেখে জমি নষ্ট করার দরকার কি ? তার মধ্যে গ্রামে সৌখিন রস চোরের উৎপাত বেড়েছে। গাছ কেটে রেখে গেলে রাতে এসে রস নিয়ে হাড়ি ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে যায়। সকালে এসে এ অবস্থা দেখলে আর গাছ কাটাতে মন চায় না। উপজেলার কান্দিগাঁও এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুই জন গাছি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য হাড়ি বসাচ্ছেন।
প্রশ্নের জবাবে গাছি সুবহান হোসেন বলেন, আমরা চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে এসেছি মুক্তাগাছায়। আমরা কান্দিগাঁও এলাকায় ৭০টি খেজুর গাছ লিজ নিয়ে রস সংগ্রহ করছি। পরে এই রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে বিক্রি করি। আরোও অনেক গাছ লিজ নিতে পারতাম কিন্তু লোক সংকটের জন্য নিতে পারিনি। খেজুর গাছ মালিক আলামিন বলেন, আমার খেজুর গাছ লিজ দিয়েছি। একটি খেজুর গাছের জন্য এই সিজনে আমাকে এক কেজি গুড় দিবে। এছাড়াও মাঝে মধ্যে সকালে কাঁচা রস নিতে পারবো খাওয়ার জন্য। গাছি নাই বিধায় বাধ্য হয়েই এভাবে গাছগুলো দিতে হচ্ছে। আমাদের এলাকায় যদি গাছির অভাব না থাকতো তাহলে রস বেশি পেতাম। বাদে মাঝিরা গ্রামের গাছি আদম আলী বলেন, ২২ বছর ধরে গাছ কাটছি। বয়সের ভাড়ে এখন আর গাছে উঠতে পারি না। তবুও এলাকার লোকজন ছাড়ছেনা তাই বাধ্য হয়েই ছোট ছোট ২৫টি খেজুর গাছ বেঁছে নিয়েছি যেন কষ্ট কম হয়। আদম আলীর বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মানকোনে প্রায় ১ হাজারের উপরে গাছ আছে।
এই এলাকায় বংশ পরম্পরায় শুধু আমরাই গাছ কাটতাম। কিন্তু আমাদের ছেলেরা এই পেশায় আসতে রাজি না। তার মধ্যে গাছ কেটে সকালে রস সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে গেলে অনেকেই নিপা ভাইরাসের ভয়ে রস খেতে চায় না। অথচ আমরা রস সংগ্রহ করার সময়ই গাছে নেট ব্যবহার করি যেন কোন পোকা-মাকর বা বাদুর বসতে না পারে। মানকোন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম তাঁরা বলেন, গাছি সংকটে অনেক গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে পারছে না। অনেক গাছি এ পেশা ছেড়ে চলে গেছে আবার অনেকেই বয়সের কারণে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আমাদের চিরচেনা সেই খেজুর রসের পিঠা-পায়েশ খাওয়ার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এবং গাছি সংকট নিরসনে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গাছি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করি। মুক্তাগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন বলেন, আমাদের খেজুর গাছ নিয়ে আলাদা কোন কার্যক্রম নেই। তবে গাছি সংকটে গাছ কাটতে পারছে না এ বিষয়ে এখনও কোন কৃষক আমাদের কাছে আসেনি। তবে এ ব্যাপারে আমাদের কাছে সহযোগিতা চাইলে আমারা গাছি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো।