বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৯ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :

ত্রিশালে মাছ চাষে এআই ও সেন্সর ভিত্তিক আধুনিক ডিভাইস ব্যবহারে সফলতা

মোমিন তালুকদার

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা ইউনিয়নের প্রান্তীক মাছ চাষী মাহফুজুর রহমান। গত বছর একটি পুকুরের ৩৫০ গ্রাম ওজনের ১৪ হাজার মাছ আকস্মিকভাবে মারা যায়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৬ লাখ টাকা। চলতি বছরের শুরুতেও তার আরেকটি পুকুরের ১০ টন শিং মাছ মারা যায়। যার বাজার মূল্য আনুমানিক ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা। পরীক্ষা করে পানিতে কোন সমস্যা না পাওয়া যাওয়ায় কি কারণে মাছগুলো মারা গেল তা জানতে পারেননি তিনি। এত বড় ক্ষতি কাটিয়ে উঠা কোনভাবেই সম্ভব হবে না আর তার পক্ষে।

এ উপজেলার মৎস্য চাষিরা দেশের মাছের চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও নিয়মিত খাবার ও পরিচর্যার পরও কাঙ্খিত উৎপাদন না পাওয়াসহ মাছ চাষ করে নানা কারণে লোকসানের মুখে পড়েন মাহফুজের মতো অনেক খামারি। এ সমস্যা সমাধানে, অত্যাধুনিক অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তি ও বিদ্যমান পুকুরে ভার্টিক্যাল এক্সপানশন পদ্ধতির সমন্বিত ব্যবহারে মাধ্যমে অল্প জমিতে অধিক মাছ চাষ করে ব্যাপক সফলতা অর্জনের দাবী করেছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ি ত্রিশাল উপজেলায় তিন হাজার দুইশত হেক্টর জমিতে হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ। ৮১৪৫ জন মৎস্য চাষির বিপরিতে বছরে উৎপাদন হয় ৬৭ হাজার ৫১৫ মেট্রিক টন।

ত্রিশালের মাছ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠির আমিষের চাহিদা পূরণ করলেও দিনদিন কমছে ফসলি জমির পরিমান, কমে আসছে ধান উৎপাদনের মাত্রা। কৃষি জমি ঠিক রেখে অল্প জমিতে অধিক মাছ চাষ করে কিভাবে উৎপাদন বাড়ানোর যায় এবং কিভাবে লোকসানের হাত থেকে মৎস্য খামারিদের রক্ষা করা যায় তা নিয়ে বছর খানেক আগে পরিকল্পনা ও গবেষনা শুরু করেন ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুয়েল আহমেদ। এজন্য বছর খানেক আগে পরীক্ষামূলক ভাবে উপজেলার কানিহারী ইউনিয়নে ৫৮ শতাংশের একটি সরকারি পুকুরে নিজেদের উদ্ভাবিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ও অত্যাধুনিক সেন্সর নির্ভর অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তি ও বিদ্যমান পুকুরে ভার্টিক্যাল এক্সপানশন পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেন। মেলে অভূতপূর্ব সফলতা। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৫৮ শতাংশের ১৮ ফুট গভীরতার ওই পুকুরে ৬৫ হাজার পাঙ্গাসের পোনা মাছ দেয়া হয়।

প্রতি শতাংশের বিপরীতে ১১শ’র বেশি মাছ পরেছে। যার প্রতিটি মাছের গড় ওজন ছিল ৫৫ গ্রাম। ৬ মাসে প্রতিটি মাছের গড় ওজন দাঁড়িয়েছে ১২৫০ গ্রামে। এ পদ্ধতির বিপরিতে প্রচলিত পদ্ধতিতে ৬৫ হাজার পাঙ্গাসের পোনা মাছ দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের পরিমাণ বড় করতে হলে সাড়ে ৪ একর জমির প্রয়োজন হয় বলে জানান সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সামসুজ্জামান। কেননা, সাধারন মৎস্য চাষের পুকুরের গভীরতা থাকে ৫-৬ ফুট। শতাংশে চাষ করা যায় ১৫০ থেকে ২০০ টি পাঙ্গাস মাছ। তিনি আরো বলেন, সরেজমিন এ প্রকল্পের পুকুর পরিদর্শনে এসে অবাক করার মতো যা দেখলাম তা হলো, এত বেশি মাছ থাকা সত্বেও ৬ মাস পালনে প্রতিটি মাছের গড় ওজন ১২৫০ গ্রাম হয়েছে।

এ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে অবশ্যই চাষিরা উপকৃত হবেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ওই ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপস জানান দেয়, পুকুরে অক্সিজেন, পিএইচ, টিডিএস, টেম্পারেচারের মাত্রা কত এবং সেই মাত্রার ভিত্তিতে সয়ংক্রিয়ভাবে এয়ারেটর যন্ত্র অন বা অফ করে। এ্যামোনিয়ার পরিমান বাড়লো কিনা, সেটা জানানোর সাথে সাথে এর পরিমান বেড়ে গেলে সয়ংক্রিয়ভাবে ড্রেনেজ পাম্প ও এয়ারেটর যন্ত্র অন করে পুকুরের তলদেশের বর্জ্য পদার্থ কমাতে কাজ করে। মাছের প্রজাতি অনুসারে কখন কি পরিমান খাবার প্রয়োজন সেটা জানা যায় এবং সেই অনুযায়ি সয়ংক্রিয় ফিডার মেশিন খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করে। এসব কাজে মানুষের কোন প্রকার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়ে না।

রেইন সেন্সর ও ওয়েদার ফোরকাষ্টিং টুলস ব্যবহারের ফলে মাছ চাষি বৃষ্টির সম্ভাবনা ও তাপমাত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য আগে থেকেই জানতে পারে। একটি চাষ চক্রে খামারে কি পরিমান বিদ্যুতের ব্যবহার হয়েছে, কত কেজি খাবার পুকুরে প্রয়োগ করা হয়েছে, কোন এয়ারেটন যন্ত্র কত সময় ধরে চলেছে তার সঠিক ও নির্ভুল হিসাব অ্যাপসের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এসব বিষয় সাধারন চাষিদের অজানা থাকার কারণে মাছ বিক্রির পর অধিকাংশদের লোকসান গুনতে হয়। পরিক্ষামূলক চাষে সফল হওয়ায় এখন প্রশিক্ষণ, অন্য প্রজাতির মাছের জন্য পাইলট প্রকল্প গ্রহন ও চাষী পর্যায়ে প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুয়েল আহমেদ।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ওই পুকুরপাড়ের চারপাশে রাখা আছে খাবার ছিটানোর ৪টি যন্ত্র। অক্সিজেন সাপ্লাই বাড়ানোর জন্য পানির নিচে ও উপরে স্থাপন করা হয়েছে আট ধরনের ৮টি এয়ারেটর যন্ত্র। এর সবই পরিচালনা করে এআই বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। প্রয়োজন অনুসারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সয়ংক্রিয় ভাবে চালু হচ্ছে যন্ত্রগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এক একর জমির পুকুরে এই প্রযুক্তি অনুসরণ করে মাছ চাষ করলে, সেন্সরসহ অন্যান্য মেশিনারিজ সামগ্রী ক্রয়ে খরচ হবে সর্বোচ্চ ৩-৫ লাখ টাকা। এই পাইলট প্রকল্পের কারিগরি পরামর্শক রনি সাহা বলেন, অত্যাধুনিক অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তি ও বিদ্যমান পুকুরে ভার্টিক্যাল এক্সপানশন পদ্ধতির সমন্বিত ব্যবহারে ১৮ থেকে ২০ ফুট গভীরতার পুকুরে শতাংশে ১২শ পাঙ্গাশ মাছ পালন করা যায়। যা সাধারনের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। অল্প জমিতে বেশি মাছ চাষ করার পাশাপাশি সাশ্রয় হয় খাবার, কায়িক শ্রমের ব্যবহার ও ফলন পাওয়া যায় তুলনামূলক কম সময়ে। পুকুরের পানির গুনগত মান নিয়ন্ত্রিত থাকায় এই পদ্ধতিতে চাষকৃত মাছ স্বাদে ও হয় অনন্য। উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুয়েল আহমেদ জানান, ত্রিশালের অধিকাংশ মানুষ মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত।

কৃষি জমি রক্ষা করে, বিদ্যমান যেসব পুকুর আছে সেইসব পুকুরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ডিভাইস ও ভার্টিক্যাল এক্সপানশন পদ্ধতির মাধ্যমে কিভাবে উৎপাদন বাড়ানোর যায় এবং লোকসানের হাত থেকে খামারিদের রক্ষা করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহন করি। ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন এমনটা দাবি করে তিনি বলেন, এ টেকনোলজি ব্যবহারে অল্প জমিতে অধিক মাছ চাষ করে অত্যাধিক লাভবান হওয়া যাবে এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ার জন্য অত্যান্ত টেকসই হবে নতুন উদ্ভাবিত এই দেশীয় প্রযুক্তি। অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রিশাল উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর সভায় ১৩টি পুকুরে পাইলট প্রকল্প হিসেবে অল্প জমিতে অধিক পরিমাণ মাছ চাষ কাজ শুরু করা হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন :

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । দৈনিক প্রলয়